• ঢাকা
  • বুধবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ০৮ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

ডেঙ্গুতে ৭ দিনের ব্যবধানে ভাই-বোনের মৃত্যু


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ৩১ আগষ্ট, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ০৩:০৯ পিএম
৭ দিনের ব্যবধানে
ডেঙ্গুতে দুই শিশুর মৃত্যু

নিউজ ডেস্ক : ঢাকার মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়ার তাজ লেন। চৌরাস্তার মোড়েই বহুদিন ধরে ভ্যানের ওপর চায়ের দোকান বসিয়ে ব্যবসা করেন রবিউল আলম। গতকাল বুধবার পাঁচজন লোক তাঁর দোকানে জটলা পাকিয়ে চা খাচ্ছিলেন। পাইকপাড়ায় ইব্রাহিম নামে যে ব্যক্তির দুই সন্তান ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মারা গেছে, তাঁর বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে চা বিক্রেতা বললেন, ‘ভাই, কয়দিন ধরে কাঁদছি আর চা বিক্রি করছি। আত্মীয়স্বজন কেউ না, তবু মনে পড়লে কান্না চলে আসে। পরপর দুই শুক্রবার দুই সন্তান হারালেন মা-বাবা।’

চায়ের দোকান থেকে দুইশ গজ দূরে হতভাগ্য ওই পরিবারের বাড়িটি দেখিয়ে দিলেন রবিউল। ওই সময় চায়ের দোকানে উপস্থিত খোরশেদ আলম নামে আরেকজন বললেন, ‘অনেক বছর এই এলাকায় বেকারির দোকানে মালপত্র সাপ্লাই দিয়ে আসছি। ১৮ আগস্ট সকালে এসে দেখি, লাশবাহী গাড়ি। এর সাত দিন পর একই বাসার সামনে আবার লাশবাহী গাড়ি। হৃদয়টা ভেঙে গেল। জ্যান্ত দুইটা বাচ্চা চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল! করোনার শুরুতে এই পাইকপাড়ায় একদিন দেখলাম, এক লোক রাস্তায় পড়ে আছে। করোনা আক্রান্ত হওয়ায় কেউ ধারেকাছেও যাচ্ছিল না। আমি একা ওই লোকটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। আমি তো মরি নাই। এখন মশায় একেকজনের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।’

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৮ আগস্ট মারা যায় মো. ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতির ছেলে আরাফাত হোসেন রাউফ। সাত দিনের মাথায় ২৫ আগস্ট না ফেরার দেশে চলে যায় রাউফের বোন ইসনাত জাহান রাইদা (৭)। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর ৯ বছর পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল রাউফের। ছেলের জন্মদিন ঘিরে এরই মধ্যে নানা পরিকল্পনা করেছিলেন মা-বাবা। নানা-নানুসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে সিলেটে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল তাদের। হঠাৎ ডেঙ্গু একটি সাজানো সংসার এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। পরপর এমন ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’র কথা কী করে ভুলবেন স্বজনরা! পাইকপাড়ার বাসার অদূরে আইকন একাডেমিতে কেজিতে পড়ত রাউফ; একই প্রতিষ্ঠানে নার্সারিতে ছিল তার বোন রাইদা। দুই সন্তান ছিল মা-বাবার কাছে সত্যিকারের রাজকন্যা ও রাজপুত্র। সন্তানরা অপেক্ষা করত কবে শুক্রবার আসবে।  দিন মা-বাবার সঙ্গে চিড়িয়াখানা, শিশু পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যানসহ নানা জায়গায় ঘুরতে যাবে। এমনকি নতুন নতুন রেস্টুরেস্টে খেতেও পছন্দ করত ওরা। শুক্রবার ছিল ওদের সবচেয়ে প্রিয় দিন। কারণ, কর্মজীবী বাবাকে ওই দিনটিতে সারাক্ষণ কাছে পেত দুই ভাইবোন। সেই প্রিয় দিনই ওরা পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিল। দুই শিশুর বাবা ইব্রাহিম টেকনিক্যাল মোড়ে বেবিলন গ্রুপ নামে একটি তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানে পরিবহন শাখায় চাকরি করেন। পাশাপাশি তাঁর নিজের রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা রয়েছে। ইব্রাহিমের স্ত্রী গৃহিণী। মধ্য পাইকপাড়ায় দুই শিশুর নানাবাড়ি।

পাইকপাড়ায় গিয়ে ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বললেন, আমার সব শেষ। কিছু বুঝে ওঠার আগে রাজপুত্র আর রাজকন্যাকে হারালাম। ভাগ্যকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কী বলব? কত স্বপ্ন ছিল! সাধ্য অনুযায়ী সন্তানদের সব সাধ পূরণ করার চেষ্টা করেছি। কয়েক দিন আগে প্রাইভেটকারও কিনেছিলাম। দুই ভাইবোন একসঙ্গে নিজেদের গাড়িতে স্কুলে যাবে বলে। আগে কখনও আমি মোটরসাইকেলে স্কুলে দিয়ে আসতাম, আবার কখনও রিকশায় যেত। এখন এই গাড়িতে কে চড়বে! ঘরের কোনায় ওদের স্মৃতিচিহ্ন। যে ঘরে ওদের পায়ের চিহ্ন পড়বে না, সেখানে বসবাস করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সেপ্টেম্বর থেকে বাসা ছেড়ে দিয়েছি।

ইব্রাহিম বললেন, এমন কোনো রাত ছিল না, যে রাতে দুই ভাইবোনকে না খাওয়াতাম। আমরা তিনজন এক বালিশে ঘুমাতাম। এ জন্য কোলবালিশ ব্যবহার করতাম। হাতের এক পাশে ঘুমাত ছেলে, আরেক পাশে মেয়ে। কে কোন পাশে ঘুমাবে– এ নিয়ে ঝগড়া হতো ওদের।
ইব্রাহিম আরও বলেন, ১৬ আগস্ট প্রথম ছেলের হালকা জ্বর দেখা দেয়। এর পর স্থানীয় এক ডাক্তারের কাছে নিলে ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য বলেন। ওই দিন রক্ত পরীক্ষা করানো হয়। পরদিন ১৭ আগস্ট ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। এর পর ওই চিকিৎসকের কাছে আবার নেওয়া হলে তিনি বাসায় চিকিৎসা দেওয়ার পরামর্শ দেন। ১৮ আগস্ট ছেলে পেটব্যথার কথা জানায়। এর পর ওই দিন আবার ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয়। প্রথম পরীক্ষায় প্লাটিলেট এক লাখ ৬২ হাজার ছিল। দ্বিতীয় পরীক্ষায় ১৫ হাজারে নেমে আসে। ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় মিরপুরের ডেল্‌টা হাসপাতালে ছেলেকে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালে যাওয়ার আগে ছেলে শুধু বলছিল, ‘বাবাকে ডাক দাও। আমার পেটে ব্যথা করছে।’

মধ্য পাইকপাড়ার যে বাসায় ওই পরিবারের বসবাস, গত এক মাসে সেখানে আরও ৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। ২০-২৫ দিন আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দুই শিশুর বাবাও। দুই সন্তানকে হারিয়ে শোকে পাগলপ্রায় ওদের মা। বুকে তীব্র ব্যথা নিয়ে দু’দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি।

দুই শিশুর পরিবার ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, মধ্য পাইকপাড়ার অনেক বাড়িতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। ঠিকঠাক এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ ছিটানো হয় না। এমন মর্মান্তিক ঘটনা কারও পরিবারে না ঘটে– এই প্রার্থনা করেছেন দুই শিশুর মা-বাবা।
স্বজনরা জানান, রাউফের লাশ সাভারের হেমায়েতপুরে দাফন করা হয়। ওই এলাকায় ইব্রাহিমের কিছু জমি-জমা রয়েছে। যদিও তাঁর গ্রামের বাড়ি ভোলা। যে রাতে ছেলে মারা যায়, সেই রাতে মেয়ে রাইদার জ্বর আসে। সেই রাতে ঢাকায় ফিরে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয় রাইদার। পরদিন তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। ডেল্‌টা ও ইবনে সিনা হাসপাতাল ঘুরে সিট না পেয়ে দালালের মাধ্যমে রাইদাকে ১৯ আগস্ট ভর্তি করা হয় ধানমন্ডির রেনেসাঁ হাসপাতালে।

দুই শিশুর বাবা ইব্রাহিমের অভিযোগ, রেনেসাঁ হাসপাতালে পাঁচ দিন রেখে সঠিকভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি তাঁর মেয়ের। সুস্থ হয়ে গেছে জানিয়ে ২৪ আগস্ট রেনেসাঁ হাসপাতাল থেকে রাইদাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। বাসায় আনার পর আবার তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নানা সমস্যা ধরা পড়ে। এর পর ওই দিন তাকে মহাখালীর ইউনিভার্সেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পিআইইউসিতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। দামি দামি সব ধরনের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল। কোনো কিছুতে আর মেয়েকে ফেরানো যায়নি। ২৫ আগস্ট সকালে চোখের সামনে মেয়েও চলে গেল।

দুই সন্তানের মা-বাবার অভিযোগ, রেনেসাঁ হাসপাতালে পিআইইউসিতে পাঁচ দিন রেখে তাঁর সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওই হাসপাতালে ভর্তির দিন চিকিৎসায় অবহেলার কথা বলে হাসপাতাল ছাড়তে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, পার্টির মাধ্যমে এসেছেন; অন্তত পাঁচ দিন থাকতে হবে। চিকিৎসায় অবহেলা ও ঘরে ছড়িয়ে থাকা সন্তানের বইখাতা দেখিয়ে কান্না থামাতে পারছিলেন না দম্পতি।

ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন

আরো পড়ুন

banner image
banner image