• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ; ২৮ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

ঈদুল আজহা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও আমাদের পরিবেশ


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: রবিবার, ১০ জুলাই, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০৪:৫৮ পিএম
কোরবানির ঈদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান
গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান

ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার

মুসলিম উম্মাহর জন্য ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সামর্থ্যবানের জন্য এটি অবশ্য কর্তব্য, কিন্তু আমরা বেশির ভাগ মানুষ ঈদের আনন্দে বিমোহিত হয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা ভুলে যাই।

উন্নত মুসলিম দেশগুলোর কোরবানির জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। যিনি বা যারা কোরবানি দেবেন, তিনি বা তারা নিজেদের পালিত পশু বা পছন্দসই গৃহপালিত পশু ক্রয় করে নির্ধারিত স্থানে দিয়ে দেন। ঈদের দিন পশুগুলোকে সরকারিভাবে হালাল ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে জবাই করে চামড়া, হাড়-মাংস ও বর্জ্য আলাদা করে, শুধু হাড়-মাংস পশু মালিকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অতঃপর চামড়া প্রক্রিয়াজাতের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। রান্নার অনুপযুক্ত হাড় ও অন্য বর্জ্যগুলো সঠিকভাবে ডাম্পিং/পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এতে পরিবেশ যেমন সুন্দর থাকে,  তেমনি কোরবানির মাংস রোগ-জীবাণুমুক্ত থাকে।

কোরবানিতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট পুরোটাই উল্টা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা নিজেরাই নিজেদের পশু জবাই করি। অতঃপর চামড়া, হাড়-মাংস ও বর্জ্য আলাদা করি। কাজে দক্ষতা না থাকা এবং অসাবধানতাবশত মাংসে রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে, অদক্ষ হাতের কারণে চামড়ার গুণগত মান নষ্ট হয় এবং সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় পরিবেশ দূষণ। যেখানে-সেখানে পশুর মলমূত্র, পশুর অবশিষ্ট খাদ্য, জবাই করা পশুর রক্ত, নাড়িভুঁড়ি, পাকস্থলীর বর্জ্য, হাড়, শিং, কান, মাথার চামড়া এবং রক্তে সিক্ত থাকা চাটাই (পাটি) ইত্যাদি আমরা যেখানে-সেখানে ফেলে রাখি। নোংরা হয় পরিবেশ।

কোরবানির কয়েকদিন সারা দেশ, বিশেষ করে ঢাকার মতো জনবহুল এলাকা যেখানে নিষ্কাশন ব্যবস্থা খারাপ, সেখানে আমাদের অসাবধানতার কারণেই রক্তগুলো জমে থাকে এবং এক-তিনদিনের মধ্যে বাতাসে মারাত্মক দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে পশুবর্জ্য ও চাটাই ড্রেনে ফেলে রাখা হয়, ফলে নিষ্কাশন ব্যবস্থায় গোলযোগ সৃষ্টি হয়। কোরবানি ঈদ-পরবর্তী বৃষ্টি হলে মিশ্র পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। চারদিকে নোংরা পরিবেশ, সঙ্গে পানির উপস্থিতি—দেখা দেয় মশার উপদ্রব। কখনো মশার কামড়ে দেখা দেয় মশাবাহিত রোগ, সমস্যার অন্ত নেই। সমস্যার মূল কারণ একটাই, আমাদের অসচেতনতা। এক্ষেত্রে আমাদের অজ্ঞতাকে দোষ দেয়া যাবে না। কারণ এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যে জানে না পশুবর্জ্য ও রক্ত থেকে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়, তার পরও বছরের পর বছর আমরা এ কাজগুলো করে যাচ্ছি এবং পক্ষান্তরে নিজে দোষ না নিয়ে প্রতিবেশীকে দোষারোপ করছি। অনেক উচ্চবিত্ত লোক হয়তো জানেই না, তার কোরবানির পশুর বর্জ্যের কী অবস্থা; কারণ তার কোরবানির ব্যবস্থাপনা করে গৃহ কর্মচারী। তাহলে এখানে কি গৃহ কর্মচারীর অজ্ঞতাকে বা অসচেতনতাকে দায়ী করা হবে নাকি মূল মালিকের দায়িত্বহীনতা?

শুধু একটু পরিবর্তনের ছোঁয়া পেলেই বর্জ্য সম্পদে পরিণত হবে। মানুষের খাদ্যাভ্যাসে গরু বা ছাগলের ভুঁড়ি অনেক আগে থেকেই আছে যা অনেকের কাছে ‘বট’ নামে পরিচিত আবার কিছু মানুষ নাড়িও খেয়ে থাকে। সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করে প্রস্তুত করে রান্না করতে পারলে এগুলো স্বাদে বেশ মজাদার হয়। পশুর নাড়িভুঁড়ি, পাকস্থলীর বর্জ্য মাছের উপাদেয় খাদ্য। রক্তে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন, রক্ত থেকে পুষ্টিকর পশুখাদ্য তৈরি সম্ভব। অন্যদিকে হাড়ের গুঁড়া হাঁস-মুরগির উত্কৃষ্ট খাদ্য এবং এটি সার হিসেবেও জমিতে ব্যবহার করা যায়, হাড়-শিং থেকে বোতাম, তৈজসপত্র, ওষুধ, গৃহসজ্জা ইত্যাদি প্রস্তুত করা যায়। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এক আলোচনা সভা থেকে জানা যায়, আকারভেদে একটি গরুতে ১৫ থেকে ২৫ কেজি হাড় উচ্ছিষ্ট হয়। আন্তর্জাতিক বাজার, বিশেষ করে চীন ও থাইল্যান্ডে গরুর হাড়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। পবার সূত্রে আরো জানা যায়, বর্তমানে কোরবানির গরুর হাড়ের বাজারমূল্য প্রায় ৬৫ কোটি টাকা এবং কোরবানির মৌসুমসহ বছরের মোট জবাই করা গরুর হাড়ের বাজারমূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। প্রতি বছর ল্যান্ডফিল থেকে গরুর হাড়-শিং পৃথক ও সংগ্রহ করে সিটি করপোরেশন নিজস্বভাবে লাভবান হতে পারে অথবা এ ব্যাপারে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করে তৃতীয় পক্ষকে ইজারা দেয়া যেতে পারে। গ্রাম এলাকা বা যেখানে খোলা জায়গা আছে, সেখানে কোরবানির আগে বাসাবাড়ির পাশে খালি জায়গায় একটি গর্ত করে রাখা যায়, পশু জবাইয়ের পর রক্ত, গোবর, পরিত্যক্ত খাবার, কান, শিং, মাথার চামড়া ও পাকস্থলীর বর্জ্যগুলো এ গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে দিলে কোরবানির ঈদ-পরবর্তী দুর্গন্ধ ছড়াবে না এবং মশার উপদ্রব ও রোগবালাই সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

বিগত বছরগুলোয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কোরবানির পশু জবাইয়ের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছিল। পর্যাপ্ত প্রচারণা ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে এ কার্যক্রমে জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেয়নি। বর্জ্য সংগ্রহের সুবিধার জন্য প্রতি বছর সিটি করপোরেশন থেকে কোরবানির কিছুদিন আগে থেকে পলিব্যাগ বিতরণ করা হলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার তেমন সুবিধা হচ্ছে না। সাধারণ জনগণের মতে, পলি ব্যাগগুলো আকারে ছোট হওয়ার কারণে একটি স্বাভাবিক আকারের গরুর বর্জ্য ধারণ সম্ভব নয়, ফলে অনেকেই এসব বর্জ্য ড্রেনে বা রাস্তায় ফেলে রাখছে। ঈদের সময় সিটি করপোরেশনের অনেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাড়িতে চলে যায় এবং তাদের পরিবর্তে কেউ থাকে না ফলে কম লোকবল নিয়ে বর্জ্যস্তূপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময় নগর কর্তৃপক্ষের উচিত খণ্ডকালীন বাড়তি লোক নিয়োগ দেয়া, প্রয়োজনে দ্রুত বর্জ্য অপসারণ করতে সক্ষম এমন আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার।

২০২২ সালে পশুবর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনা হবে বলে আশাবাদী স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, পবিত্র ঈদুল আজহার দিন রাত ১০টার মধ্যে পশুর বর্জ্য অপসারণ করা হবে। এ বছর কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, তার এলাকা ঢাকা দক্ষিণে ৩৫০টি গাড়ি ব্যবহার করে পরিচ্ছন্নতাকাজে নিয়োজিত থাকবেন ৮ হাজার ২০০ কর্মী। অন্যদিকে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, তার এলাকা ঢাকা উত্তরে ৫৩৮টি গাড়ি ব্যবহার করে পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব পালন করবেন ৯ হাজার ৯০০ পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তিনি আরো বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এক লাখ বায়োডিগ্রেডেবল ব্যাগ এবং পাঁচ লাখ পলিব্যাগ সরবরাহ করা হবে। অন্যান্য বছর নির্দিষ্ট স্থানে কোরবানির জন্য ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্যান্ডেল থাকলেও লোকজন পশু কোরবানির জন্য আসত না। কারণ কাউকে বাধ্য করার ব্যবস্থা ছিল না। এবার পরীক্ষামূলক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মিরপুরের ৭নং ওয়ার্ডে পরীক্ষামূলক সাতটি পশু কোরবানির জায়গায় প্যান্ডেল থাকবে, নির্দিষ্ট স্থান ব্যতীত মানুষ অন্যত্র পশু জবাই করতে পারবে না। এ ব্যাপারে মেয়র আতিকুল ইসলাম উৎসাহ দিয়ে বলেন, ‘প্রয়োজনে আমরা গাড়ি দিয়ে আপনার বাড়িতে মাংস পৌঁছে দেব।’ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পক্ষ থেকে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে তদারক করতে ১০টি দল গঠন করা হয়েছে, তারা ১০-১২ জুলাই বেলা ২টা পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে। পরবর্তী সময়ে সচিব ও প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা প্রতিদিন প্রতিবেদন দাখিল করবেন।

গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার যে উন্নতি হয়েছে তার ছোঁয়াও এবার চামড়া ব্যবসায়ীরা পাবেন। আগের বছরের তুলনায় দ্রুত সময়ের মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে কাঁচা চামড়া ঢাকার ট্যানারিগুলোয় পৌঁছাতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।

কোরবানির ঈদে নদীস্বাস্থ্যের কথা ভুলে গেলে চলবে না, একে তো ঈদের সময় ঢাকার সব নালা হয়ে বিপুল পশুবর্জ্য নদীতে গিয়ে মিশছে। পাশাপাশি ট্যানারি শিল্পের জন্য প্রধান কাঁচামাল ‘চামড়া’ প্রক্রিয়াকরণ করতে শিল্প-কারখানা থেকে বিপুল তরল বর্জ্য নদীতে মিশে যায়। যেহেতু সাভারের হেমায়েতপুরে অবস্থিত চামড়া শিল্পনগরী কেন্দ্রীয় পরিশোধনাগার চাহিদার তুলনার কম সক্ষমতার; তাই ট্যানারি মালিকদের কাছে অনুরোধ থাকবে, নিজস্ব ইটিপিগুলো যেন ২৪ ঘণ্টা পরিচালনা করেন। প্রয়োজনে কাঁচা চামড়া গুদামে রেখে সিইটিপির সক্ষমতার সঙ্গে মিল করে ধীরে ধীরে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এ ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা অগ্রগণ্য।

বন্যাকবলিত এলাকায় কোরবানি করার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, বন্যাকবলিত এলাকায় এমনিতেই পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়, সঙ্গে খাদ্য ও ওষুধ সংকটের ফলে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরো ভয়াবহ। বন্যাকবলিত এলাকায় পশুহাট স্থাপন এবং পশু কোরবানিতে সর্বক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন হাটের বর্জ্য, পশুবর্জ্য ও উচ্ছিষ্ট যেখানে-সেখানে পড়ে না থাকে, বিশেষ করে পানিতে যেন না মিশে যায়। অপেক্ষাকৃত উঁচু ও শুষ্ক স্থানে হাট স্থাপন করতে হবে এবং পশু জবাই করতে হবে। বর্জ্য ব্যস্থাপনার জন্য শুষ্ক মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলা যেতে পারে অথবা পলিব্যাগে করে যে এলাকায় বন্যা নেই, সেখানে ব্যবস্থাপনা করা যেতে পারে।

ত্যাগের মহিমায় নানান পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন দেশবাসী পরিচ্ছন্নতার সহিত ঈদ উদযাপন করতে পারবে বলে সবাই আশাবাদী।

ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার: অধ্যাপক ও ডিন বিজ্ঞান অনুষদ; চেয়ারম্যান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

ঢাকানিউজ২৪.কম /

আরো পড়ুন

banner image
banner image