• ঢাকা
  • রবিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৮ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

বঙ্গবন্ধু পরিবারের হত্যাকান্ডের বিচার সুসম্পন্ন হলে আইনের সুশাসন হবে


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ১৭ আগষ্ট, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১২:৫২ পিএম
বঙ্গবন্ধু পরিবারের হত্যাকান্ডের বিচার সুসম্পন্ন হলে আইনের সুশাসন হবে
বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

এড. আসাদুজ্জামান

বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘন ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫, পৃথিবীর ইতিহাসে এই দিনটি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ মানবাধিকার লংঘনের দিন। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সকল সদস্য (শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহেনা ব্যতীত), আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এর পরিবার এবং শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডের শিকার হন বাড়ীর কাজের লোক,পরিবারের মহিলা সদস্য ও অবুজ শিশুরা।

এটি নিছক কোন হত্যাকান্ড নয়, এটি একটি গনহত্যা। এই গনহত্যাটি ছিল অত্যন্ত নিখুঁত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের যৌথ পরিকল্পনায় এই নৃশংস হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়। ঘটনার পূর্বে এবং পরের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে আমরা দেখি এই হত্যাকান্ডের পেছনে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল দীর্ঘদিনের। বলা হয়ে থাকে সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপদগামী জুনিয়র সেনা অফিসারগন এই হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছে, কথাটি সত্য নয়। সেনাবাহিনীর উপ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খন্দকার মোশতাক এই হত্যাকান্ডের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ৩০ মে ‘দ্যা সান ডে টাইমস’-এ খুনি লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমানের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে ফারুক রহমান দাবি করেন-'খন্দকার মোশতাকের ভাগ্নে ও আমার ভায়রা আব্দুর রশিদ প্রথমে আমার কাছে মুজিবকে সরিয়ে খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট পদে বসানোর প্রস্তাব দেন।

আমি তাতে রাজি হই ও মেজর জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনীর প্রধান করার প্রস্তাব দিই। মুজিবকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণের পর মোশতাক ও জিয়া আমাদের পরিকল্পনায় সম্মত হন'। বছরের আগস্টে লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশীদ ইংল্যান্ডের আইটিভি টেলিভিশনে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনাকালে সে সময়ের উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে তারা হত্যাকান্ডের পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করলে জিয়া তাদের এগিয়ে যেতে বলেন এবং তাদের উৎসাহিত করে বলেন, তারা সফল হলে জিয়া তাদের সঙ্গেই থাকবেন।

তাছাড়া হত্যাকান্ড ঘটানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জিয়ার সঙ্গে ফারুক-রশীদের সাক্ষাৎ এবং আলোচনা যে বহুবার হয়েছে তার প্রমাণ মেলে কর্ণেল রশীদের স্ত্রী জোবায়দা রশীদের একটি বক্তব্য থেকেও। তিনি বলেন, 'একদিন রাতে ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে (রশীদ) জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়'। ১৯৯২ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফারুক নিজেও স্বীকার করেন যে, সে ১৫ মাস ধরে মুজিব হত্যার পরিকল্পনা গুছিয়েছিল। এমনকি ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ সে তৎকালীন উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করে খোলামেলা আলোচনাও করেন।  তখন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে দিকে ইঙ্গিত দিয়ে জিয়া আরও বলেন- এটি যদি সফল হয় তবে আমার কাছে এসো, আর যদি ব্যর্থ হয় তবে আমাকে জড়িত করো না। 

১৫ই আগস্ট সকালে এমন একটি ঘটনার পর ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্ণেল সাফায়ত জামিল এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমিন আহমেদ চৌধুরী খবরটি দেওয়ার জন্য সেনা উপ-প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় ঢোকার পর দেখেন,"জেনারেল জিয়া একদিকে শেভ করছেন একদিকে শেভ করে নাই। স্লিপিং স্যুটে দৌড়ে এলেন। শাফায়াতকে জিজ্ঞেস করলেন, 'শাফায়াত কী হয়েছে?' শাফায়াত বললেন, 'অ্যাপারেন্টলি দুই ব্যাটালিয়ন স্টেজড্ এ ক্যু। বাইরে কী হয়েছে এখনো আমরা কিছু জানি না। রেডিওতে অ্যানাউন্সমেন্ট শুনতেছি প্রেসিডেন্ট মারা গেছেন।'শুনা মাত্রই জেনারেল জিয়া বললেন, সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স।" একটি দেশের স্বাধীনতার স্থপতিকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছে খবরটি শুনে যে কেউ উদ্বিগ্ন হবেন অথচ জেনারেল জিয়া ছিলেন স্বাভাবিক। এমনটি ঘটবে তা তিনি আগে থেকেই জানতেন যে কারনে তিনি উপরের মন্তব্যটি করতে পেরেছিলেন। 

খুনিদের বাঁচানোর জন্য ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্ব-ঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ (যিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার বানিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন) ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর আছে। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর আধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে।

অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ আছে-প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সুবিধাভোগী সামরিক শাসক মেজর জিয়া। তিনি ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেন। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্য এবং ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার লোক দেখানো তদন্ত কমিটি গঠন করেন খন্দকার মোশতাক। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে এ দেশের ইতিহাসে বর্বরতম হত্যার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত করে দেন এবং খুনীদের দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের  কূটনৈতিক দায়িত্ব প্রদান করেন, যা লন্ডনে গঠিত তদন্ত কমিশনের রিপোর্টেও বলা হয়েছে। ১৫ই আগষ্টের ঘটনায় শুধু দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন তা নয়। এই নারকীয় হত্যাকান্ডে বিদেশি শক্তিগুলোর ষড়যন্ত্র ছিল সক্রিয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে দৃশ্যত যে দুজন বিদেশি উল্লসিত হন, তাদের একজন হলেন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার, অন্যজন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো।

লেখক : এড. আসাদুজ্জামান, আইনজীবি, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট

ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন

আরো পড়ুন

banner image
banner image