সাইদুর রহমান
ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচারের অতিষ্ঠ হয়ে এ ভূখন্ডের মানুষ জাতিভেদে তাঁদের দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, হে সৃষ্টিকর্তা এমন একজন মহামানবের জন্ম দাও, যে মানুষটি শোষিত শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়াবে এবং কান্ডারীহীন জাতিকে মুক্তির পথ দেখাবে । অবশেষে বিধাতা এ ভূখন্ডের মানুষের আকুতি মন্জুর করেন । ১৯২০ সালে ১৭ মার্চ রোজ বুধবার মা সায়েরা খাতুনের ঘরকে আলোকিত করে ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো। বাবা শেখ লুৎফর আদর করে ডাকলেন খোকা । বংশের প্রথম পুত্র হিসাবে খোকার ছিলেন সবার নয়নমণি ।প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডীতে পাড়ি দিলেন । পায়ে হেঁটে গ্রামীণ পথ দিয়ে স্কুলে যাতায়াত করতেন খোকা ।
গ্রামের মানুষ তাঁকে প্রচন্ড ভালবাসতেন। ছোট কালে তিনি দুষ্টু প্রকৃতির ছিলেন। তিনি খেলা - ধূলা ও গান পছন্দ করতেন । তিনি ছিলেন ভীষণ একগুঁয়ে । তাঁর বই পড়া ছিল পছন্দের তালিকায় অন্যতম ।
তাঁর একটা ফুটবল দল ছিল । খেলার ক্ষেত্রে বাবার টিমকেও ছাড় দিতেন না । যদিও বাবার টিমের সাথে তাঁর টিম পরাজিত হয়েছিল । খোকার মা শহরে থাকতেন না। তিনি বলতেন আমি শহরে গেলে এত সম্পত্তি দেখবে কে ? খোকার দাদা এবং নানার বাড়ি পাশাপাশি হওয়াতে তিনি নানার ঘরেই ঘুমাতেন বেশী।খোকা বাবার কাছ থেকে লেখা - পড়া শিখেছেন ।বাবার গলা ধরে না ঘুমালে খোকার ঘুম আসতো না। বংশের বড় ছেলে ছিল বলে তাঁর আদর যত্ন ছিল প্রাপ্তির চেয়ে বেশী ।
১৯৩৪ সালে খোকা সপ্তক শ্রেণীতে পড়া অবস্হায় তিনি ভীষণ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন । দুবছর পড়া - লেখা হয়নি, তাঁর চোখে গ্লুকোমা নামক এক রোগ ধরা পড়ে। এরপর থেকেই তিনি চশমা পড়েন । ঘাত - প্রতিঘাত অতিক্রম করে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করলেন । এরপর তিনি স্কুল অতিক্রম করে কলেজের চৌকাঠে পাড়ি দিলেন । তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন ।এখানেও বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য আন্দোলনে সমর্থন করার দায়ে বিশ্ববিদ্যাল কতৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে বহিস্কার করেন । পুরোদমে রাজনীতির সাথে সংসার শুরু করলেন তিনি । এ দেশের দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের মুক্তির কথা সর্বক্ষণ ভাবতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।
পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজকে একত্রিত করার লক্ষে তিনি ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন । ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা " উর্দু " হবে এর পক্ষে অবস্থান করেন মুসলিম লীগ নেতারা । পূর্ব পাকিস্তানের বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস এর তীব্র প্রতিবাদ করে বঙ্গবন্ধু সহ সবাই বললেন, বাংলা এবং উর্দূ দুইটি ভাষাকেই রাষ্ট্র ভাষা করতে হবে। ১০ মার্চ " বাংলা ভাষা গর্ব দিবস " ঘোষণা করা হলো । ১১ মার্চ রাজপথ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হলেন । তিনি ছাব্বিশ মাস ধরে বিনা বিচারে কারাগার ভোগ করেন ।তিনি বললেন আমি কোন অন্যায় করিনি। সুতারাং আমি জেলের বাইরে যাব, হয় আমি জ্যান্ত অবস্হায় না হয় মৃত অবস্হায় । " Either I will go out of the jail or my deadbody will go out " তিনি প্রতিবাদী হয়ে বললেন, তোমরা এতদিন বিনা বিচারে জেলে রাখতে পারোনা। তিনি পরিস্কার বলে দিলেন ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মুক্তি না দিলে, আমি আমরণ অনশন করবো। ফরিদপুর কারাগারে তিনি অনশন শুরু করলেন । বঙ্গবন্ধুর অনশন ভাঙ্গানোর জন্য জেলকতৃপক্ষ সাধ্যমতো চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন । সারা পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য ক্ষোভে - বিক্ষোভে ফেটে যাচ্ছে ।
তখন ফরিদপুর জেল গেইট সহ সারা বাংলা " রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই " এই স্লোগানে মুখরিত ছিল । আমাদের দেশের মানুষের বহু ত্যাগ আর বঙ্গবন্ধুর এই অনশনই রাষ্ট্র ভাষা বাংলা পাই। দিনে দিনে পাকিস্হানী শাসক গোষ্ঠীদের শাসন ও শোষণের নিষ্ঠুরতার পরিধি ও সীমানা দুটিই অতিক্রম করে ফেলে । পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের স্বাধীনতা ও অধিকারকে শ্বাসরুদ্ধ করার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সারা দেশে আন্দোলন ও সংগ্রামেরর পটভূমি তৈরী করেন। স্বাধীনতা পাবার জন্য এ দেশের মানুষকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে । পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা ইতিহাসের পাতায় বিরল অধ্যায় রচনা করে।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন । তিনি সাতকোটি মানুষের মুক্তির সনদ অথবা বাংলাদেশর মানুষের সংস্কৃতির অন্যন্য অলিখিত দলিল প্রদান করলেন। প্রকৃত পক্ষে তিনি ৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ৭ মার্চের ১৮ মিনিটের ভাষণের সারমর্ম বুঝার স্বার্থে বিশ্বের এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৩টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইতিহাস নিজের অঙ্গ নিজে ছেদ করেনা । শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের তেমন এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ ।শুধু বাংলার ইতিহাসে নয়, বিশ্ব-ইতিহাসেও তিনি অচ্ছেদ্য ।
তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষ মুক্তি ও স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিল । বঙ্গবন্ধু মুক্তি ও স্বাধীনতার মন্ত্রে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন বলেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নিবার্চন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসওরের গণঅভ্যুত্থান এবং সওরের নিবার্চনে জয়লাভ করেছিলেন । দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক, ছোটবেলা থেকেই ছিলেন উদার ও মহানুভব ।সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফজল বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বর্ননা করতে গিয়ে লিখেছিলেন " শালপ্রাংশু দেহ শেখ মুজিবের মুখের দিকে চেয়ে থাকা যায় অনেকক্ষণ ধরে। ঐ মুখে কোন রুক্ষতা কি কর্কশতার চিহ্ন ছিল না । তাঁর হাসি ছিল অপূর্ব, অননুকরণীয়। এমন হাসি অন্য কারও মুখে দেখেছি বলে মনে পড়ে না । "
মানুষের অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে জীবনের বেশী ভাগ সময় তাঁহার কেটেছে কারাগারে । পাহাড়ের মতো বড় ছিল তাঁর মন । জীবনে নীতি ও আদর্শের সাথে আপোষ করেননি কোনদিন। তাই সর্ত সাপেক্ষে যুদ্ধাপরাধীকে সাধারন ক্ষমা ঘোষণা করলেন । যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুনগঠনের জন্য ও মানুষের অর্থনীতিক মুক্তির জন্য তিনি লড়াই শুরু করলেন। সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবরূপ দেওয়ার জন্য তিনি বিশ্ব ব্যাপী বিচরণ করলেন ।
................ ১৫ আগস্ট। রোজ শুক্রবার। মুসলমানদের পবিত্র দিন ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যাওয়ার কথা । ভোর ছ'টায় ঘাতকরা সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা এবং যাঁর নাম এ দেশের মানুষের মুখে সবচেয়ে বেশী উচ্চারিত হয়েছে তাঁকে সহ পরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা করে । ছোট অবুঝ, নিষ্পাপ রাসেলকে তারা যখন কন্দুকের নল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যারত, তখন বাংলার আকাশ- বাতাস রাসেলের চিৎকারে কম্পিত হয়েছিল। ঘাতকরা ৭৫ এর ১৫ আগস্ট বাঙালীর ইতিহাসকে হাসিয়েছে কিন্তু কেঁদেছে বাংলার আকাশ- বাতাস, তরুলতা এবং সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। সারা বিশ্বে নেমে পড়লো শোকের ছায়া । এদেশের মানুষের মনেও এ হত্যাকান্ড দ্বিতীয় কারবালা হিসাবে স্থান পেল । সেই আপোষহীন মহাপুরুষের বাংলার মাটিতে জন্ম না নিলে মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারতাম না, লাল সবুজের পতাকা পেতাম না, স্বাধীন জাতি হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতাম না।আর স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন থেকে যেত অধরাই।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: