![website logo](https://www.dhakanews24.com/webimages/logo.png)
মাহফুজুর রহমান
শফী আহমেদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন সোমবার বিকেলে। ৩ জুন ২০২৪। যারা তাঁর কফিন বহন করেছেন, যারা তাঁকে কবরে শুইয়ে দিয়েছেন; জানি না, তাদের কাছে শফী আহমেদের ভার কেমন লেগেছে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে হতবিহ্বল অগণিত ভক্ত, সুহৃদ, শুভানুধ্যায়ী, গুণগ্রাহী, রক্তের আত্মীয় এবং আত্মার আত্মীয় যারা, তারা কীভাবে এ মৃত্যু-বাস্তবতা মোকাবিলা করছেন, কে জানে! শেকসপিয়র জানতেন, প্রতিটি বিদায়ের মধ্যেই মৃত্যুর উপাদান থাকে। আর যা চিরবিদায়, তা মানুষকে কোন মৃত্যুর স্বাদ দেয়? শারীরিক মৃত্যু, না তার চেয়ে বেশি কিছু?
শফী আহমেদ নেত্রকোনার ছেলে। ১৯৮০ সালে ঢাকায় আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ওঠেন হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে। জড়িত হন বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তখন জাসদ রাজনীতির দাপট। সে বছর জাসদে ভাঙন এলে ছাত্রলীগেও ভাঙন আসে। ডাকসু ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না ও জিএস আখতারউজ্জামান বাসদের পক্ষে অবস্থান নেন। ১৯৮১ সালের ডাকসু নির্বাচনে মান্না-আখতার পুনরায় জয়ী হন। কিন্তু এবারে ভিন্ন অবস্থান থেকে। পরের বছর একই ধারাবাহিকতায় আখতার-বাবলু বিজয়ী হন। জাসদ সমর্থিত মুনীর-ফিরোজ কিংবা মুনীর-হাসিব পরিষদ নির্বাচনে সুবিধা করতে পারেনি। সংগঠনও দুর্বল থেকে যায়। ১৯৮২ সালে দেশে সামরিক শাসন এলে জাসদের মধ্যে নতুন মেরূকরণ দেখা দেয়। আ স ম রবের নেতৃত্বে একাংশ সামরিক শাসকের বহু কর্মসূচির সমর্থন শুরু করলে জাসদ ও ছাত্রলীগে আরেক দফা ভাঙন অবধারিত হয়। শফী আহমেদ তখন ছাত্র রাজনীতিতে তাঁর জায়গা খুঁজে নেন। তাঁর কর্মী বাহিনীকে নিয়ে তিনি নিত্য স্বৈরাচারবিরোধী চ্যালেঞ্জিং কর্মসূচিতে লিপ্ত।
শীর্ষস্থানীয় ছাত্রনেতারা পিছুটান দিলে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শূন্যতা তৈরি হয়। সে শূন্যতা পূরণে শফী আহমেদ সচেষ্ট হন নিরলসভাবে। ১৯৮৪ সালে তিনি ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হন। ১৯৮৬ সালে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হন। ১৯৮৯ সালে সাধারণ সম্পাদক। তাঁর নেতৃত্বে সম্পূর্ণ তরুণ এক প্রজন্ম ছাত্রলীগের পতাকাতলে সমবেত হয়।
শফী আহমেদের ছাত্র রাজনীতি শেষ হওয়ার আগে আগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন রাজনীতিতে কিছু মেরূকরণ স্পষ্ট হতে থাকে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বলীয়ান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম। এর মধ্যে কাজী আরেফ আহমেদ একাত্তরের ঘাতকদের বিচার দাবিতে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে জোটবদ্ধ হলে জাসদ রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব পড়ে। জাসদের মধ্যে আওয়ামী লীগপন্থি একটি ধারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে দলে সূক্ষ্ম টানাপোড়েন শুরু হয়। শফী আহমেদ তখন কাজী আরেফের প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন।
একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের প্রতি নিষ্ঠ থাকেন। দুর্ভাগ্যজনক, কাজী আরেফ আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে শফী হঠাৎ রাজনৈতিকভাবে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের সূত্রে ইতোমধ্যে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় আওয়ামী লীগের। গণআন্দোলনের জোয়ারে জাসদের বলয় ছেড়ে নিকটস্থ নেতাকর্মী নিয়ে তিনি যোগ দেন আওয়ামী লীগে। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক হন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপকমিটির সদস্য হন। দুর্ভাগ্যজনক, ছাত্র রাজনীতির যে উদ্দামতা, গতি ও আপাত বিশুদ্ধতা শফীকে ছাত্র আন্দোলনের তুঙ্গে তুলতে পেরেছিল; জাতীয় রাজনীতির কলুষতা, কায়েমী স্বার্থ, সুবিধাবাদীদের দৌরাত্ম্য, অপরাজনীতির আধিপত্য শফীকে ক্রমাগত সেখানে অপাঙ্ক্তেয় করে তোলে।
যে নেত্রকোনায় তাঁর বাবা আওয়ামী রাজনীতি ধরে রেখেছিলেন, শফীর আওয়ামী লীগে যোগদান সেখানে অনেক আলোড়ন ও আশা সৃষ্টি করেছিল। তিনি প্রতিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট পাওয়ার জন্য মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। কেবল ২০০৬ সালে একবার তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য, সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তী সময়ে কোনো নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন পাননি।
আমি শফী আহমেদের বহু বন্ধু ও নিকটজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁর অনেক অনুরাগীর লেখা পড়েছি। তারা বিভিন্নভাবে বলেছেন, সংগঠন বা রাজনীতিতে শফী আহমেদের প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি। কেউ বলছেন, তাঁর অভিমান ছিল। তিনি হয়তো অভিমান বুকে নিয়ে চলে গেছেন। বঞ্চনার ভার তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। অভিমান কিনা জানি না, তবে অস্থিরতা যে ছিল, তার সাক্ষী আমি নিজে। সমাজ কীভাবে এগোতে পারে, দেশ কীভাবে উন্নত হতে পারে, ওসব নিয়ে শফী আহমেদের নিজস্ব ভাবনা ছিল। স্বপ্নও ছিল। স্বপ্নাহত কেউ মৃত্যুকে নীরবে আলিঙ্গন করে কিনা জানি না।
তিনি তরুণ অবস্থায় স্বাধীনতার নিউক্লিয়াসের মতো অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্যও একটা নিউক্লিয়াস বানাতে চেয়েছিলেন। আমি জানি, এ উদ্যোগে যোগ দিতে তিনি অনেককে আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ বহু আগে পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। কেউ জেলা শহরে আইন পেশা চর্চা করেন, কেউ মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন। কেউ আমার মতো চাকরিজীবী, কেউ ব্যবসায়ী। কেবল শফী শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠ থাকতে চেয়েছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতে।
শেষ দিকে যখন কথা হতো, মনে হতো রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর নতুন কোনো পরিকল্পনা আছে তাঁর। অর্থহীন, কদর্য, বেনিয়াবৃত্তির রাজনীতির বিপরীতে নতুন কোনো উপলব্ধি ছিল। আমরা হয়তো হারালাম তাঁর নতুন কোনো স্বপ্নের মানচিত্র। মৃত্যুতে শফী কিছু হারাননি। জালালুদ্দিন রুমি যেমন বলতেন– মৃত্যুই আফসোস করবে, রুমি করবে না।
মাহফুজুর রহমান: সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সাবেক ছাত্রনেতা
ঢাকানিউজ২৪.কম / এইচ
আপনার মতামত লিখুন: