• ঢাকা
  • শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২০ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

চীন কি মধ্যপ্রাচ্য জয় করতে চলেছে?


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ০৪:১৬ পিএম
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন তাদের দুই দেশের সীমানা
সৌদি আরবে চীনের প্রেসিডেন্ট

জুমার্ত ওতোরবায়েভ

মাত্র কয়েক বছর আগেও এটা কল্পনা করাও খুব একটা বাস্তবসম্মত হতো না যে আমেরিকার দীর্ঘদিনের কৌশলগত মিত্রদেশ সৌদি আরব চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কোনো অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা জোটে যুক্ত হবে। যা-ই হোক, গত মাসে সৌদি আরব সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনে (এসসিও) ‘সংলাপ অংশীদার’ মর্যাদা লাভের জন্য একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে। পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি প্রথম পদক্ষেপ।

১৯৮০-এর দশকে এসসিও গড়ে ওঠার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। সে সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন তাদের দুই দেশের সীমানা নিয়ে সৃষ্ট হওয়া উত্তেজনা নিরসনে উদ্যোগ নিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির পর দুই পক্ষ থেকে সেটি পাঁচ পক্ষে পরিণত হয়। রিপাবলিক অব চায়না, রাশিয়া ফেডারেশন, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান। ২০০১ সালে এই তথাকথিত সাংহাই-৫ সম্মত হলো যে সীমানাবিরোধ ও সীমানা থেকে সামরিক শক্তি হ্রাস—এ দুটি বিষয় পেছনে রেখে আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি সামনে রেখে তারা অগ্রসর হবে। ফলে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) জন্ম হলো।

সাংহাই ৫-এর সঙ্গে ভারত, পাকিস্তান ও উজবেকিস্তান যুক্ত হয়েছে। ইরান এ বছর যুক্ত হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এসসিওতে ৯টি সংলাপ অংশীদারও রয়েছে। দেশগুলো হলো আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কম্বোডিয়া, মিসর, নেপাল, কাতার, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক  ও সদ্য যুক্ত হওয়া সৌদি আরব। আরও পাঁচটি দেশ একই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আফগানিস্তান, বেলারুশ ও মঙ্গোলিয়া—এই তিন দেশ এসসিওতে পর্যবেক্ষক মর্যাদাসম্পন্ন।

ন্যাটোর সঙ্গে তুলনা করলে এসসিও সে রকম সামরিক জোট নয়, আবার এটা শুধু অর্থনৈতিক সংস্থাও নয়। এসসিও সনদে দেখা যাচ্ছে, সংস্থাটির কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে নিরাপত্তা সহযোগিতা।  এসসিও–এর সদস্যদেশগুলো নিয়মিতভাবে যৌথ সামরিক মহড়া ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, আগস্ট মাসে রাশিয়ার চেলাবিনস্ক অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদবিরোধী যৌথ মহড়ার পরিকল্পনা করেছে সংস্থাটি।

সৌদি আরব তাদের আনুগত্য সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বিক্রির জন্য মাঠে নেমেছে। এসসিওতে যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৌদি আরব চীনের আধিপত্যে পরিচালিত ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক আবেদন করেছে। ব্রিকসের অন্য সদস্যদেশগুলো হলো ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা । গোল্ডম্যান স্যাকসে ২০০১ সালে ব্রিকস ধারণাটি প্রথম জন্ম হয়। ২০০৬ সালে এটি বাণিজ্য জোট হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ হয়। কালক্রমে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭-এর ভূরাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে ব্রিকস নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।

এসসিওতে প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত হওয়ার জন্য সৌদি আরবের এই পদক্ষেপ চীনের জন্য একটি বিজয়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে চীন তার ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ খুঁজছে। এই প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে চীন যেসব কূটনৈতিক উপকরণ ব্যবহার করছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দৃষ্টান্ত হিসেবে, চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার তিন সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে সৌদি আরব এসসিওতে যুক্ত হতে সমঝোতা স্মারকে সই করেছে। এখন যদি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত নিরসনে চীন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় নামে, তাহলে কারও বিস্মিত হওয়া উচিত নয়।

চীনের যে অর্থনৈতিক প্রভাব তাতে, এ ধরনের কূটনৈতিক অর্জন সম্ভব। এসসিও সমঝোতা স্মারকে সই করার মাত্র দুই দিন আগে ২৭ মার্চ যে ঘটনাটি ঘটল, সেটাকে কোনোভাবেই কাকতালীয় বলা যাবে না। পেট্রোলিয়াম খাতে বিশ্বের বৃহৎ কোম্পানি সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আরামকো ঘোষণা দেয়, তারা ৩৬০ কোটি ডলারে চীনের একটি পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানির ১০ শতাংশ কিনে নিয়েছে। সৌদি আরামকো এরই মধ্যে চীনে যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে, তা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের রপ্তানির তুলনায় চার গুণ বেশি। নতুন চুক্তির ফলে চীনের তেল পরিশোধনাগারে আরামকো প্রতিদিন ৬ লাখ ৯০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করবে।

সৌদি আরব তাদের আনুগত্য সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বিক্রির জন্য মাঠে নেমেছে। এসসিওতে যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৌদি আরব চীনের আধিপত্যে পরিচালিত ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক আবেদন করেছে। ব্রিকসের অন্য সদস্যদেশগুলো হলো ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। বিনিয়োগকারী সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকসে ২০০১ সালে ব্রিকস ধারণাটি প্রথম জন্ম হয়। ২০০৬ সালে এটি বাণিজ্য জোট হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ হয়। কালক্রমে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭-এর ভূরাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে ব্রিকস নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ডলারের বিকল্প হিসেবে একক মুদ্রা চালুর ব্যাপারেও ব্রিকসের দেশগুলো আলোচনা করেছে।

ব্রিকসের মোট সম্পদের ৭২ শতাংশের জোগান দেয় চীন। জোটটি আরও সম্প্রসারিত হলে, যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্য লেনদেন চীনা মুদ্রা রেনমিনবিতে সম্পাদন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার। যদি সেটা না-ও হয়, তারপরও সৌদি আরবের সঙ্গে তেল কেনার ব্যাপারটি রেনমিনবিতে নিষ্পত্তি করতে পারে চীন। রাশিয়ার সঙ্গে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস ইতিমধ্যে রেনমিনবিতে কিনছে  চীন। বিশ্বের মোট জ্বালানি তেলের ১৫ শতাংশের ক্রেতা চীন। এ প্রেক্ষাপটে তেল উৎপাদনকারী অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও চীন একই বন্দোবস্তে যেতে পারে।

এটা নিশ্চিত যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীন খুব তাড়াতাড়ি যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে দিতে পারবে না। এর বড় কারণ হলো, উপসাগরীয় অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশের প্রধান নিরাপত্তা অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরব তাদের দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি চালু রেখেছে। গত মাসেই রিয়াদের একটি সামরিক পরীক্ষাগারে প্রথমবারের মতো ড্রোন আক্রমণ ঠেকানোর কৌশল নিয়ে যৌথ অনুশীলন হয়ে গেল। একই সময়ে সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭৮টি বোয়িং কেনার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা দেয় এবং আরও ৪৩টি বিমান কেনা হতে পারে বলেও জানায় দেশটির কর্তৃপক্ষ।

তারপরও মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ। এসসিএতে সৌদি আরবের যুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টাকে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এখনই এতটা গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, এটা এখনো অনেক সময়ের ব্যাপার। কিন্তু তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যে হুয়াই ৫-জি প্রযুক্তির গ্রহণের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছেন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁদের দৃষ্টিতে বিবেচনা করা চীনা নিরাপত্তা প্রযুক্তি যেন বন্ধ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করে দেয়, চীনের সঙ্গে সহযোগিতা করলে দেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সৌদি আরবের দৃষ্টিতে, যুক্তরাষ্ট্রই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নষ্ট করেছে। ২০২০ সালের নির্বাচনের প্রচারণাকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সৌদি আরবকে একঘরে করে দেওয়ার হুমকি দেন। যদিও এরপর বাইডেন তাঁর অবস্থান নরম করেছেন, কিন্তু কিছু মৌলিক বিধিনিষেধ অব্যাহত রেখেছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে সৌদি আরবকে অস্ত্র সরবরাহ না করার মতো বিষয়টি রয়েছে।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের দুজন সিনেটর সম্প্রতি সৌদি আরবের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ইয়েমেন যুদ্ধে তাঁদের সম্পৃক্ততা তদন্তের জন্য একটি প্রস্তাব এনেছেন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, মার্কিন তদন্তের ব্যাপারে সৌদি আরব যদি ৩০ দিনের মধ্যে সহযোগিতা না করে, তাহলে তাদের সব ধরনের নিরাপত্তা সহযোগিতা স্থগিত রাখতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে অসন্তুষ্ট হয়েই সৌদি আরব চীনের দিকে ঝুঁকেছে। সৌদি আরব এই প্রথম রাজনৈতিক দর-কষাকষির বিবেচনা থেকে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শিবিরে নিয়ে আসার চীনের এই প্রচেষ্টার কৌশলগত অভিঘাত রয়েছে।

ঢাকানিউজ২৪.কম /

আরো পড়ুন

banner image
banner image