• ঢাকা
  • সোমবার, ৩ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ১৭ জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

রাজনৈতিক দলগুলো তিন জোটের রূপরেখা কি ভুলে গেছে?


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: রবিবার, ২৬ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ০১:৩৩ পিএম
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পথ খুঁজে পাবে
তিন জোটের রূপরেখা কি ভুলে গেছে?

এম এ আজিজ

জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর নিরবচ্ছিন্ন অনুপস্থিতি ধাপে ধাপে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই অকার্যকর করে ফেলছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও সন্ত্রাসমুক্ত নির্বাচন আয়োজন করে; তেমনই বিরোধী দলও অংশ নিয়ে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর করে থাকে। 

১৯৭০ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খান লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) অধীনে পাকিস্তানে প্রথম সরাসরি নির্বাচনের ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নিশ্চিত হেরে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস আগে প্রতিষ্ঠিত বিএনপি সেই নির্বাচনে ২০৭টি এবং আওয়ামী লীগ ৫৪টি আসন পায়।

যা হোক, বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে কেন্দ্র করে কিছু রাজনৈতিক দল মাঠে সক্রিয়। অর্থাৎ দেশের রাজনীতি এখন বড় দুই দলকেন্দ্রিক। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া অন্য কোনো দল রাজনীতির মাঠে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম নয়। এক দল আরেক দলের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া দূরে থাক, জাতীয় ইস্যুতেও এক টেবিলে বসতে নারাজ। বরং রুটিনমাফিক একে অন্যকে বিষোদ্গার করে চলেছে। 

এটা ঠিক, স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত বেশির ভাগ সংসদ নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব কাজ করেছে। আবার ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের নির্বাচনগুলোতে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছামতোই বিরোধী দল নির্বাচিত হয়েছে। কিন্তু দেশে শান্তি, প্রগতি ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে বড় দুই দলসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জাতির প্রয়োজনে ঐকমত্য এখন সময়ের দাবি। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ বিষয়ে মধ্যস্থতার জন্য দুই দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না।
অথচ আশির দশকজুড়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে ১৯৯০ সালের ২১ নভেম্বর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দল, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দল ও বামপন্থি ৫ দল এক ‘তিন জোটের রূপরেখা’ গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য জনগণের কাছে অঙ্গীকার হিসেবে ঘোষণা করেছিল। দেশের নতুন প্রজন্ম ওই ‘রূপরেখা’ সম্পর্কে অবগতও নয়। জনগণের বড় অংশ ওই রূপরেখার গুরুত্ব ভুলে গেছে। নব্বই-পরবর্তী সরকারগুলো রূপরেখার অধিকাংশ অঙ্গীকার রক্ষা করেনি। 

রাষ্ট্রপতি এরশাদ ক্ষমতা ছেড়েছেন ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। তারপর থেকে যেসব রাজনীতিবিদ ‘তিন জোটের রূপরেখা’ ঘোষণা করেছিলেন, তারাও সেটা বাস্তবায়নের দাবি উচ্চারণ করেন না। বাস্তবে ‘তিন জোটের রূপরেখা’ বাস্তবায়ন করা গেলেই দেশের ‘অসুস্থ রাজনীতি’ বিদায় নেওয়ার পথ প্রশস্ত হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পথ খুঁজে পাবে। 
তিন জোটের রূপরেখার মূল লক্ষ্য ছিল পরবর্তী সরকারব্যবস্থা কেমন হবে। যেমন–

১. হত্যা, ক্যু, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ধারায় প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচারী এরশাদ ও তার সরকারের শাসনের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকল্পে:

ক. সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রেখে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী তথা সংবিধানের ৫১ অনুচ্ছেদের (ক) ৩ ধারা এবং ৫৫ অনুচ্ছেদের (ক) ১ ধারা অনুসারে এরশাদ ও তার সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী আন্দোলনরত তিন জোটের নিকট গ্রহণযোগ্য একজন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে উপরাষ্ট্রপতি করে তাঁর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

খ. এই পদ্ধতিতে উক্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, যার মূল দায়িত্ব হবে তিন মাসের মধ্যে একটি সার্বভৌম জাতীয় সংসদের জন্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা।

২. ক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হবেন অর্থাৎ তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের অনুসারী বা দলের সাথে সম্পৃক্ত হবেন না অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য পদের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না। তাঁর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো মন্ত্রী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না।

খ. এই পদ্ধতিতে উক্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, যার মূল দায়িত্ব হবে তিন মাসের মধ্যে একটি সার্বভৌম জাতীয় সংসদের জন্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা।

গ. ভোটারগণ যাতে করে নিজ ইচ্ছা ও বিবেক অনুযায়ী প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সেই আস্থা পুনঃস্থাপন এবং তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

ঘ. গণপ্রচার মাধ্যমকে পরিপূর্ণভাবে নিরপেক্ষ রাখার উদ্দেশ্যে রেডিও-টেলিভিশনসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করতে হবে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সকল রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণার অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদের নিকট অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এবং এই সংসদের জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে।

৪. ক. জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতে দেশে সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরঙ্কুশ ও অব্যাহত রাখা হবে এবং অসাংবিধানিক যে কোনো পন্থায় ক্ষমতা দখল প্রতিরোধ করা হবে। নির্বাচন ব্যতীত অসাংবিধানিক বা সংবিধানবহির্ভূত কোনো পন্থায়, কোনো অজুহাতে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না।

খ. জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা হবে। গ. মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি সকল আইন বাতিল করা হবে।
‘তিন জোটের রূপরেখা’ বাস্তবায়ন ছাড়াও রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা পুনর্জীবিত করা যেতে পারে। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস ও অনাস্থা দূর করতে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করে সংঘটিত সকল অনাকাঙ্ক্ষিত ও অমীমাংসিত বিষয় নিরসন করা যেতে পারে। অন্যথায়, অন্তত জাতীয় ইস্যুতে বড় দুই দলের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে, শেষ পর্যন্ত দেশকে অনিশ্চিত গন্তব্যের পথেই ঠেলে দেওয়া হবে!

এম এ আজিজ: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ঢাকানিউজ২৪.কম / এইচ

আরো পড়ুন

banner image
banner image