• ঢাকা
  • শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

ভাষা আন্দোলন- কিছু স্মৃতিকথা


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: শনিবার, ২৫ ফেরুয়ারী, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ০৯:৪৩ এএম
১৯৫২ সালে আমি যখন খুবই ছোট
একুশে ফেব্রুয়ারি

সৈয়দ দীদার বখত্‌ 

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, ফেব্রুয়ারি মাস এলেই তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আমরা জনগণ এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা ধরনের অনুষ্ঠান রচনা করে থাকি। তার মধ্যে সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠান হচ্ছে একুশের বইমেলা।

বাংলা একাডেমি চত্বরে এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলায় যখন বই কিনতে যাই, তখন স্মৃতিতে ভেসে ওঠে সেই ভাষা আন্দোলনের দিনগুলো।

১৯৫২ সালে আমি যখন খুবই ছোট, সবে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, তখন বাড়িতে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছেন- এ আলোচনা শুনেছি। তখন আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা, ছাত্রহত্যা, নুরুল আমিন গদি ছাড়ো- এসব বিষয় বোঝার মতো বয়স আমার হয়নি। তবুও এইটুকু বুঝতে শিখেছি যে ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে এবং কয়েকজন ছাত্র শহীদ হয়েছেন। সঙ্গে এ কথাও মনের ভেতর আলোড়ন তুলেছিল- আমরা 'মাকে মা বলতে পারব না, নিজের ভাষায় কথা বলতে পারব না!'

সপ্তম শ্রেণিতে সবে ক্লাস শুরু করেছি। স্কুলে গিয়েছি। ভেতরে ঢুকে দেখলাম সব ছাত্র স্কুলের বারান্দায়। কেউ ক্লাসে নেই। সবাই ক্লাসরুমের সামনের বারান্দায়। আমি স্কুলের ভেতরে ঢুকতেই ছাত্ররা জানাল- আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, আমরা কেউ আজ ক্লাস করব না। আমার তখন মনে পড়ল সেই ভয়াবহ দিনটির কথা। পাকিস্তানি জান্তা ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ছাত্র হত্যা করেছে। ছাত্রদের অপরাধ, তাঁরা তাঁদের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। তাঁরা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে জানাতে চান তাঁদের দাবি। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য পাকিস্তান সরকার নির্বিচারে ছাত্রদের ওপর গুলি চালায়। এতে কয়েকজন নিহত হন।

আমাদের স্কুলের ছাত্ররা যখন বারান্দায় এসে এর প্রতিবাদে সমবেত হয়েছে, সে সময় আমি তাদের মাঝে এসে দাঁড়ালাম। ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে, মাকে মা বলে ডাকতে পারব না, বাংলায় কথা বলতে পারব না- এসব শুনে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। আমি তখন চিৎকার করে সবার উদ্দেশে বললাম- আমরা কেউ ক্লাস করব না; ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় মিছিল করব।

আমার ওই চিৎকার একটি আগুনের স্ম্ফুলিঙ্গের মতো সবার মাঝে ছড়িয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই স্কুল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে এলো। দশম শ্রেণির ছাত্ররা তৎক্ষণাৎ স্লোগান দিয়ে সবাইকে একত্র করে মিছিল বের করল। মুহূর্তের মধ্যে তালা বাজারের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল। আমরা স্লোগান দিতে দিতে রাস্তা প্রদক্ষিণ করতে লাগলাম। সব লোক আমাদের উৎসাহ ও সমর্থন দিয়ে পাশে দাঁড়াল। মুহূর্তের মধ্যে তালা বাজার ছাত্রদের মিছিলে প্রকম্পিত হলো। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।

সপ্তম শ্রেণির ছাত্র হলেও এটা বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, শিক্ষকরা আমাদের সমর্থনে ছিলেন। তাঁরাও মৌন সমর্থনে আমাদের মিছিলকে উৎসাহিত করেছিলেন।

এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলে নয়, আমি একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। আমার চাচা ছিলেন তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার আইন পরিষদের ডেপুটি স্পিকার সৈয়দ জলিল উদ্দিন হাশেমী। আমার পিতা সৈয়দ সরফুদ্দীন হাশেমী ছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর 'আজাদ হিন্দ ফৌজে'র একজন কমান্ডার। কবি সিকান্দার আবু জাফর তাঁর দেশপ্রেমে গ্রথিত তেজস্বী কবিতা দেশকে উপহার দিয়েছেন। সৈয়দ কামাল বখত্‌ ছিলেন জাতীয় সংসদের সদস্য। সৈয়দ জাহাঙ্গীর একুশে পদকপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পী। বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সৈয়দ বেদার বখত্‌। তালা থানা তথা সাতক্ষীরা জেলার পাক হানাদার বাহিনীর ত্রাস বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ কামাল বখত্‌। আমি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা।

আমরা যখন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে থানার সামনে গেছি, তখন একদল পুলিশ আমাদের মিছিলের পেছনে আসতে শুরু করল। আমরা তখন অকুতোভয়। দৃঢ় পদক্ষেপে স্লোগানে স্লোগানে উজ্জীবিত- 'রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই', 'নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই', 'ছাত্র হত্যার বিচার চাই'। কোনো ভয়ভীতি আমাদের আর পেছনে ফেরাতে পারবে না- এই দৃঢ় প্রত্যয়ে মিছিল নিয়ে এগিয়ে চলেছি।

যে সময়ের কথা বলছি তখন তালা ছিল একটি অজ পাড়াগাঁ। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি অনুন্নত থানা। চলাচলের জন্য দুর্গম কাঁচা রাস্তা। শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষের অভাব। তা সত্ত্বেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও যে পাকিস্তান সরকারের অন্যায়, অত্যাচার, অধিকার হরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে, এর উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল সেদিনের এই অর্ধশিক্ষিত অনুন্নত অঞ্চলের জনগোষ্ঠী।

মিছিলের শেষে আমরা ফিরে এসেছিলাম আমাদের বিদ্যালয়ে। সেখানে অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য ভয়াবহ বিস্ময়। স্কুল প্রাঙ্গণে পৌঁছামাত্র হেডমাস্টার সাহেব ডেকে পাঠালেন আমিসহ দশম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল হালিম ও নবম শ্রেণির ছাত্র জালালকে। হেডমাস্টার সাহেবের রুমে পুলিশের একটি দল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তারা আমাদের থানায় নিয়ে গেল এবং ব্যারাকে বসিয়ে রাখল। বুঝতে পারছিলাম আমাদের অ্যারেস্ট করা হয়েছে, কিন্তু কোনো অত্যাচার করা হয়নি।

আধা ঘণ্টার মতো অপেক্ষার পর আমরা দেখলাম আমার আব্বা সৈয়দ শরফুদ্দীন হাশেমী থানায় এসেছেন। তিনি ছিলেন স্কুল পরিচালনা পর্ষদের সেক্রেটারি। তিনি এসেই দারোগা সাহেবকে বললেন, 'ওসি সাহেব আমাকে কেন ডেকে এনেছেন এত জরুরিভাবে?'

ওসি সাহেব আমার আব্বাকে সমাদর করে বসতে বলে জানালেন, 'আপনি স্কুলের সেক্রেটারি। আপনার স্কুলের ছেলেরা আজ রাস্তায় মিছিল করেছে। এটা বেআইনি। তাই তাদের নিয়ে এসেছি। তার জন্য আপনাকে ডেকে এনেছি। এদের নিয়ে কী করব তা পরামর্শ করে ঠিক করব।' আমরা সব আলোচনাই শুনতে পাচ্ছি পাশের পুলিশ ব্যারাক থেকে।

আমার আব্বা তখন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, "ছাত্ররা কি কোনো চুরি করেছে, ডাকাতি করেছে, রাহাজানি করেছে, খুন করেছে কাউকে? তা যদি না করে থাকে, তবে কিসের অপরাধে তাদের ধরে নিয়ে এসেছেন? ওরা তো ন্যায্য দাবি নিয়ে রাস্তায় মিছিল করেছে। এটা সবার দাবি। ওরা ছাত্র হত্যার বিচার চেয়েছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চেয়েছে। ওরা গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য, হত্যার বিচারের জন্য রাস্তায় মিছিল করেছে। ওসি সাহেব, আপনি বলুন কোন অপরাধে ওদের ধরে নিয়ে এসেছেন? সরকারের কাছে যদি ওরা রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজ করে থাকে, তবে ওদের চালান করে দিন। তবে শর্ত একটাই- ওদের 'রাজবন্দি' হিসেবে চালান করুন।"

আমরা সবই শুনতে পাচ্ছিলাম। 'রাজবন্দি'র কথা শুনে মনের ভেতর এক অভূতপূর্ব শিহরণ অনুভব করলাম। ফাঁসির মঞ্চে যাঁরা জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন, মনের গভীরে ভেসে উঠল সেই সব মহান যোদ্ধার ছবি। ক্ষুদিরাম, অরবিন্দ, প্রীতিলতা, সূর্য সেনের নাম। ভাবাবেগে চোখে পানি এসে গিয়েছিল। মনে হলো হৃদয় নিংড়ানো ক্ষুদিরামের সেই অমর গান- 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। হাসি হাসি পরব ফাঁসি/ দেখবে ভারতবাসী' চিৎকার করে গেয়ে উঠি।

থানার বাইরে তখন লোক সমাগম শুরু হয়েছে। দেখলাম আমাদের ছাত্র ভাইয়েরা বাইরে ভিড় করেছে। একটু পরেই শুরু হলো আবার সেই স্লোগান- 'ছাত্র ভাইদের মুক্তি চাই'। ওসি সাহেব বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি বললেন, 'হাশেমী সাহেব, আপনার হাতে এই ছাত্রদের ছেড়ে দিচ্ছি। ওরা যেন আর মিছিল না করে।' এই বলে ওসি সাহেব আমাদের ডেকে আনলেন তাঁর রুমে। আমার আব্বা আমাদের নিয়ে স্কুলে হেডমাস্টার সাহেবের কাছে ফেরত দিলেন। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই এ দিনটির কথা মনে পড়ে এবং শিহরিত হই।

ছাত্রজীবনে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। কলেজ জীবনে শহীদ মিনার বানাতে গিয়ে পুলিশের হয়রানি, লাঠিপেটা, জেল-জুলুম, অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। এই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এক নদী রক্তের মধ্যে সৃষ্টি হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। প্রত্যাশা এক নদী রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ একটি গর্বিত রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে পৃথিবীর মানচিত্রে অন্য সব দেশের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন, বঞ্চনার ইতিহাস যতই দীর্ঘ হোক না কেন, মানুষ একসময় এসব অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেই। এটিই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। যত উন্নয়নই হোক, অধিকারবঞ্চিত মানুষ সব বাধা অতিক্রম করে প্রতিবাদের ঝড় তুলবেই। এটা প্রমাণিত হয়েছে পৃথিবীর সর্বত্র। বাংলাদেশের মানুষ এর সফল স্বাক্ষর রেখেছে পৃথিবীর বুকে। প্রতিষ্ঠা করেছে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। উদ্ভাসিত করেছে ভাষাসৈনিকদের স্মৃতি। অম্লান করেছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে।

লেখক:   সাংবাদিক; সাবেক তথ্য ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী

ঢাকানিউজ২৪.কম /

আরো পড়ুন

banner image
banner image