নিউজ ডেস্ক: রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব সফর করেছেন। তাঁর এ সফর যথেষ্ট আগ্রহ, উদ্দীপনা ও জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। এটি রাশিয়া, পশ্চিমা বিশ্ব এবং মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সম্পর্কের জটিল সমীকরণটি আবারও তুলে ধরেছে। পশ্চিমারা পুতিনকে তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখলেও, পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্য তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র বলেই মনে করছে। পুতিনের এ সফরের আয়োজনে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানাতে বিমান ও উটের মহড়া এবং বিশেষ সামরিক কায়দায় স্যালুট জানানো হয়। রাশিয়ান জেটের চারটি বিমান এ সফরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পুতিনকে মধ্যপ্রাচ্যে পুরোপুরি রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়। পশ্চিমারা যেখানে বিশ্ব থেকে ভ্লাদিমির পুতিনকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে, সেখানে এ সফর ভূরাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাঁর দৃঢ় অবস্থানকেই প্রমাণ করছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের সঙ্গে রাশিয়ার সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক যোগাযোগ। বর্তমান বিশ্বে রাশিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তেলশিল্পের প্রধান খেলোয়াড়। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরেও অনেক দূর বিস্তৃত। আমরা দেখেছি, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর পশ্চিমা বিশ্ব যখন বৈশ্বিক জ্বালানির বাজারে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছিল, তখন এর সঙ্গে একাত্ম হতে অস্বীকার করে মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশ। বিশেষভাবে বললে সৌদি আরব এ ক্ষেত্রে রাশিয়াকে একঘরে করার বিরোধিতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। সংযুক্ত আরব আমিরাতও রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারে পরিণত হয়েছে। আরব আমিরাত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে আর্থিক লেনদেনের চ্যানেল হিসেবে কাজ করে এবং কৌশলগত একটি উপায় বের করে। ভ্লাদিমির পুতিন সে জন্যই বলেছেন, ‘আপনাদের অবস্থানের কারণে আজ আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমাদের সম্পর্ক এক আশাতীত উচ্চতায় পৌঁছেছে। আরব বিশ্বের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত নিঃসন্দেহে রাশিয়ার প্রধান অর্থনৈতিক অংশীদার।’
পুতিনের এ সফরে জ্বালানি ছিল গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। পুতিন সে জন্যই তাঁর সফরে রাশিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান, দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী যেমন ছিলেন, তেমনি রাশিয়ার শীর্ষ জ্বালানি কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারাও পুতিনের সফরসঙ্গী ছিলেন। তাদের মিশন খুবই স্পষ্ট– অস্থিতিশীল তেলের বাজার স্থিতিশীল করা। সম্প্রতি তেলের দাম প্রায় পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ওপেক প্লাস তথা প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর প্রচেষ্টার সঙ্গেও এ প্রচেষ্টা সংগতিপূর্ণ। ওপেক প্লাস একটি কার্টেল, যেখানে রাশিয়াও একজন সদস্য এবং যা মূল্য নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী তেল সরবরাহ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। যদিও তেল একটি শীর্ষ এজেন্ডা আইটেম হিসেবে রয়ে গেছে; পুতিনের মধ্যপ্রাচ্য সফর অর্থনৈতিক বিবেচনার বাইরে চলে গেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট আরব-ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনায় গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভাষায়, আমরা নিশ্চয়ই আপনাদের সঙ্গে সবচেয়ে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করব। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রথমত আরব-ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের বিষয়টি আসবে। হামাসের সঙ্গে রাশিয়ার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের চলমান হামলার মধ্যেই হামাসের প্রতিনিধি দল রাশিয়া গেছে। তারা পুতিনকে সংঘাতে সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্ব দেয়।
প্রশ্ন হলো, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রাশিয়া কতটা সফল হবে। এর আগের যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছে কাতার। তাই চলমান সামরিক কর্মতৎপরতা সত্ত্বেও রাশিয়া মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে কিনা, এখন সেদিকে নজর বিশ্বের। সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকে নিশ্চয় এ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাদের এজেন্ডায় গাজায় সংঘাত কমানোর উপায় খোঁজার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে পুতিনের এ সফরের পর বিশ্ব এখন তাঁর কূটনৈতিক কৌশলের ফলের জন্য অপেক্ষা করছে। অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব, জ্বালানি শক্তির অধিকারীদের জোট এবং আঞ্চলিক সংঘাতে সম্ভাব্য মধ্যস্থতার প্রচেষ্টার বিষয়েও সফরটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় ছিল। এসব জটিল সংকটের সমাধানের আলোচনায় এ সফর মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পটভূমিতে মূল খেলোয়াড় হিসেবে পুতিনের ভূমিকাকে আরও দৃঢ় করবে।
ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক ।
ঢাকানিউজ২৪.কম /
আপনার মতামত লিখুন: