
জাফর আলম,কক্সবাজার : মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ‘জঙ্গি আস্তানা’ থেকে গ্রেপ্তার ১৭ জনের মধ্যে কক্সবাজারের দুই কলেজছাত্র রয়েছে। তারা হলো- সাদমান আরেফিন ফাহিম ও মো. ইরতেজা হাসনাত লাবিব। ভিন্ন কলেজ এবং শ্রেণি হলেও রামু উপজেলার পাশাপাশি গ্রামের বাসিন্দা তারা। দুজনের মধ্যে ছিল নিয়মিত যোগাযোগ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। স্বজন ও সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুজনই নিঃসঙ্গ এবং একাকী সময় কাটাতে পছন্দ করত। ব্যস্ত থাকত মোবাইল নিয়ে। আটক ফাহিম কক্সবাজার সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের ছাত্র আর লাবিব কক্সবাজার সিটি কলেজ থেকে চলতি এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৬ জুলাই নিরুদ্দেশ হয় ফাহিম ও লাবিব। এরপর ১৫ আগস্ট উভয়ের পরিবার জানতে পারে, কুলাউড়ার কর্মধায় থেকে স্থানীয়দের সহায়তায় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় গ্রেপ্তারদের মধ্যে তারা রয়েছে।
স্বজনরা জানান, তাদের ধারণারও বাইরে ছিল দুজন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গেছে। ফাহিম রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীকুল গ্রামের হামিদুল হকের ছেলে এবং একই ইউনিয়নের মধ্যম মেরংলোয়া গ্রামের মোহাম্মদ এনামুল হকের ছেলে লাবিব। এলামুল ও তার স্ত্রী নাছিমা খানম দুজনই স্কুল শিক্ষক। শুক্রবার (১৮ আগস্ট) সকালে নাছিমা খানম বলেন, আমার টুইন বেবি ছিল। আমি যখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন পেটে আমার একটা বেবি মারা যায়। এর একমাস পর জন্ম হয় লাবিবের। অনেক কষ্ট করে ছেলেটা জন্ম দিয়েছি, মানুষ করছি। এখন ভেবে নিয়েছি, আমার একটা ছেলে পেটে মারা গেছে, আরেকটি ছেলে মরে গেছে। এখানে শেষ, কোনো জঙ্গি ছেলের দায় নেব না।’তিনি বলেন, এখন রাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই হবে। জঙ্গি ছেলের অপরাধের দায় আমরা নেব না। আমরা রাষ্ট্রের কর্মচারী, রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ।’ নাছিমা আরও বলেন, ‘কলেজে ভর্তি হওয়ার পর একদম পড়াশোনা করতো না। আচরণেও কিছুটা পরিবতন আসে। সারা দিন বাসায় রুমে বসে মোবাইলে গেম খেলত। ঝগড়া করে একটি মোবাইল ভেঙে ফেলে। লাবিব বলতো, আমাকে সহ্য করতে না পারলে ত্যাজ্য করে দাও।’লাবিবের বাবা এনামুল হক বলেন, ‘২৬ জুলাই সকালে আমি ও তার মা স্কুলে যাই। বিকাল ৫টায় বাসায় ফিরে দেখি ছেলে বাসায় নেই। মোবাইলও বন্ধ ছিল। পড়াশোনায় মনোযোগী হতে চাপ দিলে এর আগেও ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল লাবিব। কিন্তু দুই দিন পর ফিরে এসেছিল। তাই তাৎক্ষণিক নিখোঁজের বিষয়টি থানায় জানানো হয়নি। এ ছাড়া এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। আমি এডমিট কার্ডের জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ করি এবং সিদ্ধান্ত নিই, ১৭ আগস্ট না এলে প্রশাসনকে জানাবো। এর মধ্যে বুধবার খবর আসে, জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে মৌলভীবাজারে গ্রেপ্তার হয়েছে লাবিব।’ তিনি বলেন, ‘লাবিব মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ ছিল। তাকে সাইকোলজিস্ট দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু চাকরি করতে গিয়ে সুযোগ হলো না। এ দায় আমার। হয়তো এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে উগ্রপন্থীরা।তার কাছাকাছি গ্রাম দক্ষিণ শ্রীকুলও। ওই গ্রামের হামিদুল হক দীর্ঘ ২১ বছর সৌদি আরবে কাটিয়ে ২০১৪ সালের মার্চে দেশে ফিরেছেন। বিয়েও করেন ছিকলঘাট থেকে। এরপর শুরু করেন সুতোর ব্যবসা। বড় ছেলে ফাহিম জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ায় খবরটি শুনে খুব লজ্জিত হামিদুল। তিনি জানান, ফাহিম রামু খিজারী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর ভর্তি হয় রামু কলেজে। তবে আমাদের ইচ্ছেতে পরের বছর ভর্তি হয় কক্সবাজার শহরের সিটি কলেজে। ফাহিম কলেজে ভর্তির পর পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে ওঠে। সারাদিন বাসায় বসে থাকতো। পরে তাকে ব্যস্ত রাখতে চাকরি করতে বলা হয়েছিল।
গত ২৬ মার্চ ৩ হাজার টাকা বেতন ও পণ্য ডেলিভারির কমিশনের ভিত্তিতে কক্সবাজার শহরের ‘পাঠাও কুরিয়ার সার্ভিস’ এ চাকরি নেয়। সেখান থেকে ২৫ জুলাই বাড়িতে যায়, পরদিন ২৬ জুলাই থেকে নিরুদ্দেশ। ফাহিম একা থাকতে পছন্দ করত, প্রায়শ ব্যস্ত থাকতো মোবাইল ফোন নিয়ে। ফাহিম নিখোঁজের পর থানায় কিংবা প্রশাসনের কাউকে অবহিত করেননি। তবে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানান ফাহিমের মামা জাফর আলম। মা হাসিনা বেগমের ধারণা, তার ছেলেকে কেউ মগজধোলাই করে বিপথগামী করেছে।পাঠাও কুরিয়ার সার্ভিস’ কক্সবাজার অফিসের কর্মকর্তা রানা দাশ বলেন, ‘ফাহিমের ঘনিষ্ঠজন ইমরান থেকে একবার খোঁজ নিই, পরে আর নিইনি। কর্মচরীরা অফিসে আসবে, কাজ করবে, হিসাব দেবে এটুকু। এরই বাইরে কারও ব্যক্তিগত বিষয়কে গুরুত্ব দিইনি। ফতেখাঁরকুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ভুট্টো বলেন, ‘ফাহিমের মামা জাফর আলম আমার ঘনিষ্ঠজন। সে আমাকে জানায়, ফাহিমকে পড়াশোনায় চাপ দেওয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে বুধবার গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়টি জেনেছি। পু
লিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘রামু থানার দুজন শিক্ষার্থী জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানতে পেরেছি। তাদের এলাকাগুলোতে তৎপরতা শুরু করেছি। যেখানে তাদের চলাচল বেশি ছিল, সেসব এলাকায় পুলিশ তৎপরতা চলছে। পাশাপাশি দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নজরদারি বাড়ানো হবে।
একইসঙ্গে কারা কারা তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেসব ব্যক্তির ব্যাপারে নজরদারি করা হচ্ছে।’গত ১৫ আগস্ট মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কর্মধায় থেকে স্থানীয়দের সহায়তায় জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছেন, গ্রেপ্তাররা নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র সদস্য। তাদের বিশ্বাস, ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে ভারতীয় উপমহাদেশে জিহাদের নেতৃত্ব দেওয়া হবে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। তারা পাঁচদিনের রিমান্ডে আছেন।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: