• ঢাকা
  • বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৪ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অবলম্বন করেই পথ চলতে হবে


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০২:০৩ পিএম
মুক্তিযুদ্ধের ৫১তম বিজয় দিবস
মুক্তিযুদ্ধ

মোনায়েম সরকার
১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫১তম বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনটিতে ২৬ মার্চ ’৭১-এ সূচিত মহান মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ৩০ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমাদের দামাল মুক্তিযোদ্ধারা মিত্র বাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতায় ‘অপরাজেয়’ পাক-হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে এ বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। 

এ দিনটিতেই ৯৫ হাজার পাক-হানাদার বাহিনীর সদস্য তাদের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ 

কিন্তু বলদর্পী পাক সামরিক শাসকরা বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করে ২৫ মার্চ গভীর রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের ওপর অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে ঐ রাতেই গ্রেফতারের আগে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেশবাসীকে যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই বর্বরতার নিন্দা এবং বাংলাদেশের পক্ষে সাহায্য ও সহযোগিতার উদাত্ত আহবান জানান। যে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ অপরাহ্নে কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, সেই ময়দানেই ক্ষমতাদর্পী পাক হানাদার বাহিনীকে ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্নে আত্মসমর্পণ করতে হয়। 

এবারের বিজয় দিবস বাঙালি জাতির কাছে নতুন পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে হাজির হয়েছে। 

ইতোমধ্যে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে এবং তাদের অধিকাংশের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তার আগে ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর গড়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ভূমিধ্বস বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। 

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক সর্বসম্মত রায়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির চূড়ান্ত রায় দিয়ে দেশ ও দেশবাসীকে পিতৃহত্যার দায় থেকে মুক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ৪৭ বছর (মাঝে পাঁচ বছর আওয়ামী লীগ শাসন ছাড়া) দেশে বঙ্গবন্ধুকেই অপাংক্তেয় করে রাখা হয়েছিল। তখন স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় উদ্যাপন ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এ কালপর্বে যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা আওয়ামী লীগ, প্রতিবেশী মিত্র দেশ ভারতের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে এবং সা¤প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উস্কে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। তারা কথায় কথায় ভারতকে বাংলাদেশের সকল সমস্যার জন্য দায়ী করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে স্বার্থ হাসিল করার প্রয়াস পেয়েছে। 

স্বাধীনতাবিরোধীদের কাছে বাংলাদেশের বিজয় দিবসের তাৎপর্য তাদের বিশ্বাস ও অস্তিত্বের পরিপন্থী। কারণ বিজয় দিবস মানে পাকিস্তানের পরাজয়ের দিবস। আর পাকিস্তানের পরাজয়কে বিএনপি-জামায়াত জোট নিজেদের পরাজয় বলেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূলে আঘাত করেছিল। মর্মান্তিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক ওই হত্যাকান্ডের সুবিধাভোগী জিয়া-এরশাদ ও খালেদা-জামায়াত জোট সরকার আমাদের পবিত্র সংবিধানকে বিকৃত করে তাতে পাকিস্তানি ভাবধারা প্রতিস্থাপন করেছিল। খুনিদের রক্ষায় এহেন হীন পন্থা নেই, যা তারা গ্রহণ করেনি। 

জিয়া-এরশাদ ও খালেদা জিয়ার জোট সরকারের আমলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালের বন্ধু প্রতিবেশী ভারতকে হেয় করার জন্য তাকে ‘নন্দঘোষ’ বানানো হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তারা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের সাথে চলতে স্বস্তিবোধ করে। তাদের শাসনামলে বকলমে পাকিস্তানের কুখ্যাত আই.এস.আই রাষ্ট্র পরিচালনায় গভীর ভূমিকা পালন করে। ভারতকে অস্থিতিশীল করার জন্য আই.এস.আই-কে বাংলাদেশ ভূখন্ড ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে তারা। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফাকে ট্রেনিং, অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য-সহযোগিতা করার অনুমতি দিয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। যে ভারত নয় মাস বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীকে অতুলনীয় সহযোগিতা করেছে, মুক্তিবাহিনীর লক্ষ লক্ষ সদস্যকে ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়ে হানাদার পাক বাহিনীর মোকাবেলা করতে সক্ষম করে গড়ে তুলেছে, তাদের প্রতি ওই মনোভাব ও আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ১৪ হাজার ভারতীয় সেনাসদস্য রক্ত দিয়েছেন, অসংখ্য আহত হয়েছেন। সে কথা আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করলেও এদেশীয় পাকিস্তানি দালালরা তা করে না। ভারতীয় সৈন্য ফিরে যাওয়ার সময় আমাদের কী কী নিয়ে গেছে, সেগুলো ফলাও করে প্রচার করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পাকিস্তানি দালালরা কখনও বিবেকের দংশন অনুভব করেনি। তখন ঘটা করে প্রচার করা হয়েছে, ভারতীয় সেনাবাহিনী সেনানিবাসের বাতিগুলো পর্যন্ত নাকি খুলে নিয়ে গিয়েছিল। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তখন ক্ষমতাসীন না হয়ে অন্য কেউ ক্ষমতাসীন থাকলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সাফল্য আসতে কতদিন লাগত, তা গবেষণার বিষয়। প্রসঙ্গত তিব্বতের দালাইলামার পরিণতির বিষয় এখানে আসতে পারে। 

অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে দালাইলামা যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছেন, আমাদেরও তেমন অবস্থা হওয়ার শঙ্কা ছিল। দূরদর্শী নেত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন করে, পরাশক্তি আমেরিকা ও চীনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োজিত করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিণতি দিতে। সেই নেত্রীকে খাটো করতেও পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা পিছপা হয়নি। এর চেয়ে অকৃতজ্ঞতা আর কী হতে পারে! যে রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন, যে মঞ্চ থেকে ইন্দিরা গান্ধী স্বাধীনতার পর ঢাকা সফরকালে বঙ্গবন্ধুসহ ভাষণ দিয়েছিলেন, সে স্থানটিকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে এবং পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণের লজ্জামুক্ত করতে সে স্থানটিতে নির্মিত ‘ইন্দিরা মঞ্চ’ ভেঙ্গে শিশুপার্ক নির্মাণ করেছিলেন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া। অন্যদিকে উদার মনোভাব প্রদর্শন করে ভারতের জনগণ কলকাতা শহরে দুটি সড়কের নামকরণ করেছে শেরে বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর নামে। আমরা কিন্তু আজ পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধী বা ইন্দিরা গান্ধীর নামে কোনো সড়ক বা স্থাপনার নামকরণ করতে পারিনি।

আমরা একথা ভুলে যাই যে, ইতিহাস বদলানো গেলেও ভূগোল বদলানো যায় না। আমরা যদি প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতকে কারণে-অকারণে শত্রæর পর্যায়ে ঠেলে দিই, তাহলে নিজেদের উন্নতি করার সময় ও সুযোগ কীভাবে পাবো? ভারত একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, এটা বাস্তবতা। তার অর্থনৈতিক অবস্থান এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম। 

তার সামরিক শক্তি বিশ্ব সামরিক শক্তির উল্লে¬খযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছেছে। তার সাথে পাকিস্তানের মতো গায়ে পড়ে বিবাদে লিপ্ত হওয়া কি বাংলাদেশের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ? ভারতের ভূত দেখতে দেখতে পাকিস্তানের আজ কী হাল হয়েছে, সে দিকেও আমাদের খেয়াল রাখা প্রয়োজন। অথচ পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক ও বেসামরিক সরকারগুলো (১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের সরকার ছাড়া) আমাদের সে পথেই চালিত করেছে। পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হচ্ছে ‘দেশের স্বার্থ’। এ কথা মনে রেখে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করতে পারলে সব ঝুটঝামেলা ও অহেতুক বিরোধ থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি।  সেজন্য কারও প্রতি নতজানু হতে হবে, এমন কথাও নেই।

বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার সম্পন্ন হয়েছে, মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত খুনিদের বিরুদ্ধে আদালতের দেওয়া রায় কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, আলবদরদের বিচারের মাধ্যমে সাজা কার্যকর হয়েছে। 

এগুলো অনেক বড় অগ্রগতি এ জাতির জীবনে। এসব কথা একসময় চিন্তাও করা যেত না পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটানো হয়েছিল। রাজনৈতিক অগ্রগতির এ প্রক্রিয়া বানচাল করার চেষ্টাও চলছে বিরোধী পক্ষ থেকে বিভিন্ন অপ্রধান ও উটকো ইস্যুকে সামনে এনে। আমাদের মনে রাখা চাই, বন্ধুপ্রতিম ভারতের প্রতি বিদ্বেষ পরিহার করে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বনের মাধ্যমেও দেশ এগিয়ে চলেছে উন্নয়নের ধারায়।

আজকের এ বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত জনগণের সামনে এই সত্য নতুনভাবে তুলে ধরা দরকার যে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতা উপলব্ধি করে শান্তি, সহিষ্ণুতা, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথেই আমাদের পথ চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানি নীতি-আদর্শের প্রতি অনুগত দল, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ দেওয়া যাবে না।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন

আরো পড়ুন

banner image
banner image