নিউজ ডেস্ক : শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আরজ আলী মহান মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোণা অঞ্চলের একজন কিংবদন্তিতুল্য শহীদ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এবং নৈতিকতা ও মানবিকতার দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে যে ক'জন স্বাধিকার আন্দোলন থেকে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহন করেছেন তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৪৫ সনের ১ ফেব্রুয়ারী নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরের নওয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলহাজ্ব নবী হোসেন এবং মাতার নাম আলহাজ্ব শাহরজান বানু।
শৈশবে পিতৃবিয়োগের পর একমাত্র বড় ভাই আলহাজ্ব মিরাজ আলীর স্নেহে-আদরে তিনি বেড়ে উঠেন। নওয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাগ্রহনের পর এন জারিয়া-ঝাঞ্জাইল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সনে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। তারপর নেত্রকোণা মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সনে আই.এ এবং ১৯৬৫ সনে বি.এ পাশ করেন। ১৯৬৪ সনে তিনি নিজ এলাকার তরুণদের সংগঠিত করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে বিশেষ ভুমিকা রাখেন। ১৯৬৫ সনে সুসঙ্গদুর্গাপুরে স্বৈরশাসক আইয়ুব খাঁনের বিপক্ষে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় বিশেষ ভুমিকা রাখেন। ১৯৬৫ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন শাস্ত্রে ভর্তির পর থেকে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তিনি যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে উঠেন।
এরই ধারাবাহিকতায় মানুষ এবং দেশকে ভালবাসার মন্ত্রে দীক্ষা নেয়া এ শহীদ ১৯৬৬র ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তখন তিনি তৎকালীন ইকবাল হলের আবাসিক ছাত্র। ছাত্রলীগের প্যানেলে ১৯৬৬-৬৭ শিক্ষাবর্ষে ডাকসু ইকবাল হল শাখা সংসদের নির্বাচনে তিনি সমাজসেবা সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। যে সংসদের ভিপি ছিলেন প্রখ্যাত জননেতা জনাব তোফায়েল আহাম্মেদ। তাঁর ভাগ্নে বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াজেদ আলী বিশ্বাসের সূত্রে জানা যায় যে, শেখ ফজলুল হক মণির সাথেও তাঁর ছিল ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সম্পর্ক। ১৯৬৭ সনে কৃতিত্বের সাথে দর্শনশাস্ত্রে এম এ পাশ করে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েও- তিনি গণতন্ত্র ও স্বাধিকার তথা বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের কথা ভুলে যাননি। ১৯৬৮ সালে প্রথমে ইশ্বরগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ে এবং পরবর্তীতে ১৯৬৯ সনে নেত্রকোনা মহাবিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০এর নির্বাচন পর্যন্ত ছয় দফার আলোকে সুসঙ্গদুর্গাপুরের জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতেন। এ কারণে ১৯৬৯র গণ অভ্যুত্থানে সুসঙ্গদুর্গাপুরের 'ছাত্র-জনতা সন্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ'-এর তিনি ছিলেন আহ্বায়ক । জনগণকে সংগে নিয়ে এসময় আইয়ুবপন্থী বিডি মেম্বারদেরকে তিনি স্বপক্ষ ত্যাগ করতে আহ্বান জানান। কিন্তু কিছু বিডি মেম্বার তা করতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি আন্দোলনকারীদের সাথে নিয়ে তাদেরকে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করেন। এ সময় কেন্দ্র থেকে সংগৃহীত ফর্মে বিডি মেম্বারদের পদত্যাগ কার্যকর করার জন্য তাদের বন্ডসইও গ্রহণ করেন । সফল গণ অভ্যুত্থানের পর এলাকায় শিক্ষার সুযোগ বিস্তারে সুসং মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি বিশেষ ভুমিকা রাখেন।
১৯৭০র ঐতিহাসিক জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচার ও উদ্বুদ্ধকরণেও তাঁর ভুমিকা ছিল অগ্রণী। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তাঁর ছাত্র(বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব নুরুল আমীন,জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, নেত্রকোণা) ও স্নেহধন্যদের (সাবেক সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব জালাল উদ্দীন তালুকদার ও রুহুল কুদ্দুস ফরাজী) বরাতে জানা যায় যে, তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক সংগঠক ও পথ প্রদর্শক। তিনি বহু ছাত্র ও তরুণকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করতে উদ্বুদ্ধ করেন।
সর্বপ্রথম তিনি তাঁর বাড়িতে অবস্থানকারী আপন ভাগ্নে ওয়াজেদ আলী বিশ্বাস, লজিংয়ে থাকা মাদ্রাসা ছাত্র আব্দুল জব্বার মুন্সী এবং পাশের গ্রামের ছাত্র মতীন্দ্রকে ভারতের বাঘমারায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিবন্ধন করান। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী হবার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর ছাত্র ও ঘনিষ্ঠ তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণ অব্যাহত রেখেছিলেন । ভারত সীমান্তবর্তী তাঁর বাড়িটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারীদের এক ট্রানজিট ক্যাম্প। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নে বিভোর এ শহীদ বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর সদ্যজাত ভ্রাতুষ্পুত্রের নাম রাখেন 'মুজিব' এবং সদ্যজাত এক ভ্রাতুষ্পুত্রীর জন্যে অভিনব এক নাম রাখেন 'রাষ্ট্রন্নেছা'। আগস্টের শুরুতে মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠন ও সহযোগিতা করার অভিযোগে পাকি কর্ণেল তাঁকে নেত্রকোণা ক্যান্টনমেন্টে তলব করে এবং জানিয়ে দেয় যে, আগামী এক সপ্তাহ পর্যন্ত তিনি যেন স্টেশন লিভ না করেন, এবং এর ব্যতিক্রম কিছু হলে তাঁর স্বজন সকলকে মেরে ফেলা হবে। একথা শুনে তিনি আর পালানোরও চেষ্টা করেন নি ।
অতঃপর স্বাধীনতার শত্রুরা ১৯৭১র আগস্টের ৯/১০ তারিখে তাঁর বাড়ি-ঘর লুটপাট করে এবং পুড়িয়ে দেয়। তারপর ১২ আগস্ট বর্তমান নেত্রকোণা সরকারি কলেজের টীচার্স মেস থেকে পাকিবাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে। নেত্রকোণা থেকে দু'দিন পর নিজ এলাকা সুসঙ্গ দুর্গাপুরের বিরিশিরিস্থ সেনাক্যাম্পে তাঁকে স্থানান্তর করা হয়। পাকি হানাদারদের মেজর সুলতান হায়দার খাঁন পাঠান তাঁর জনপ্রিয়তায় বিস্মিত হয়ে তাঁকে জীবন রক্ষার জন্যে- প্রচুর সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতাগ্রহন করে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করার লোভনীয় প্রস্তাব পেশ করেন।! কিন্তু তিনি তা তীব্র ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। তিনি অকুতোভয়ে প্রস্তুত থাকেন শহীদী মৃত্যুর জন্যে। এলাকাবাসীর সূত্রে এবং ২০০২ সনে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে 'প্যারাকমান্ডো ওয়ার্কশপ'-এ অংশগ্রহনকারী সৈনিক রোকন উদ্দিনের ভাষ্যমতে জানা যায় যে, আশ্চর্যজনক ও কাকতালীয়ভাবে ইসলামাবাদের সেই ওয়ার্কশপে তার সাথে পরিচয় তুলে ধরেছিলেন- শহীদ অধ্যাপক আরজ আলীকে অস্ত্রপ্রয়োগে হত্যাকারী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতান হায়দার খাঁন পাঠান।
তারপর তিনি বলেন, "যুদ্ধের প্রাককালেই সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী স্বাধীনতাপন্থীদের হত্যা করার যে তালিকা আমরা পাই, তাদের মধ্যে অধ্যাপক আরজ আলীর নামও ছিল। স্বাধীনতাপন্থী কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতাদের সাথে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। তার মতো বাংলাদেশপ্রেমী ও অটল আপোসহীন ব্যক্তি ওখানে আমরা আর পাইনি। বাধ্য হয়েই আমাদেরকে তাঁকে হত্যা করতে হয়েছে। প্রথমে আমরা তাকে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনের জন্য বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাব দেই, কিন্তু তিনি তাতে রাজী হননি। তাঁকে বলি, ঠিক আছে আপনি বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করছেন করুন, কিন্তু এখনো তো পাকিস্তান টিকে আছে, তাই অন্ততঃ একবার 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' বললে আপনাকে মুক্তি দেয়া হবে। কিন্তু তিনি ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করলেন।
অবশেষে জোরপূর্বক পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলানোর জন্য তাঁকে আমরা ২৯ বার বেয়োনেট চার্জ করি, কিন্তু আমরা তারপরও তাঁকে দিয়ে তা বলাতে পারিনি, আমরাই পরাস্ত হই। অতঃপর (১৬ আগস্ট রাতে) আমরা তাঁকে গুলি করে হত্যা করি"। একই ভাষ্য দিয়েছেন, দুর্গাপুরের ভুলিগাঁও নিবাসী সাবেক সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আয়ুব আলী। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক পাকিস্তানি বন্ধুর সংগে দেশে ফেরার পথে পেশোয়ারে যান। সেখানেও কাকতালীয়ভাবে তাঁর সাথেও এই পাকি আর্মি অফিসারের সাক্ষাৎ হয়েছিলো এবং একই ভাষ্য দিয়েছিলো।
১৯৭২ সনে গেজেটভুক্ত এ শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্মৃতিতে বাংলাদেশ ডাকবিভাগ ডাকটিকেট প্রকাশ করেছে, নেত্রকোনা সরকারি মহাবিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর নামকরণ করা হয়েছে, জীবনী নিয়ে বাংলাদেশ বেতার কর্তৃপক্ষ নাটক মঞ্চস্থ করেছে, গ্রন্থকার-কলামিস্টরা এখনো তাঁকে নিয়ে লিখে যাচ্ছেন। তাঁর বীরত্বপূর্ণ জীবনগাথাকে কেন্দ্র করে 2022 এর অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে 'একাত্তরের বিষাদ সিন্ধু' উপন্যাস, যা পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে । স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ২০২১ সনে তাঁকে শহীদ বুদ্ধিজীবী/বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবারো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং গেজেটভুক্ত করা হয়েছে। এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কতৃক সনদপ্রাপ্ত হয়েছেন । এদিকে ১৯৭৩ সনে সুসং সরকারি মহাবিদ্যালয়ের সামনের রাস্তাটি তাঁর নামে নামকরণ করা সত্বেও তা এখনো নামফলকবিহীন ও পরিচয়হীন। সড়কটি স্থায়ী নামফলকসহ পুনঃস্থাপনের জন্যে প্রশাসনিক সমস্ত শর্ত পূরণ হওয়ার পরেও ২০১৭ সাল থেকে অদ্যাবধি তা বাস্তবায়িত হচ্ছেনা। যা অত্যন্ত দুঃখজনক! এব্যাপারে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সকলের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
১৯৭২ সনে জনতার সাথে ঐকতানে একাত্ম হয়ে এদেশের বাউল সম্প্রদায় শোকে ও শ্রদ্ধায় তাঁকে নিয়ে রচনা করেছিলেন অমর এক গান-
কই গেলা ভাই আরজ আলী ?
তোমার জন্য কান্দিতেছে শত শত বাঙালি ।
আল্লাহতালার রহমে, জন্ম নিলা নওয়াপাড়া গ্রামে ;
পাশ করিলে বি এ, এম এ, ফুটলো দেশে গোলাপকলি ।।
এই ফুলের মকরন্দে মোহিত করেছে গন্ধে ;
মনেরই আনন্দে গেয়ে ফিরে ভ্রমর অলি ।।
করলেন তিনি প্রফেসারী , দেশ-বিদেশে নামজারী ;
পাগল হইয়া পুরুষ-নারী দিতো কত পুষ্পাঞ্জলি ।।
আরেক কথা মনে উঠে , কইতে কলিজা ফাটে ;
পাকিস্তানের পাল্লায় উঠে-
শয়তান মরদূত এক্স আলী,
শয়তান মরদূত ওয়াই আলী,
শয়তান মরদূত জেড আলী।
যুক্তি করে সেই কজনা, দেশে যোগ্য লোক রাখবেনা;
এই সাহেবকে মারলো নিয়া করিয়ে রাইফেলের গুলি ।।
মৃত্যুকালে সাহেব বলে , ওগো আল্লাহ , তুমি স্বাধীন করিও সোনারবাংলা ;
জঁপতে জঁপতে ইল্লাল্লাহ , স্বর্গপুরে গেলেন চলি ।।
তাঁর মৃত্যুর খবর শুনি , কাঁদে মা গর্ভধারিনী ;
কাঁদে তাঁর ভ্রাতা-ভগ্নী , আর যত বংশাবলী ।।
এই বাউলের মনের ব্যথা , ভুলতে নারি উনার কথা ;
হাসরের দিন বিধাতা , দেখাইও তাঁর রূপাঞ্জলি।।
কই গেলা ভাই আরজ আলী?
তোমার জন্য কান্দিতেছে শত শত বাঙালি।।
যে কান্না নেত্রকোণা অঞ্চলে আজো থামেনি । আজও তিনি মানুষের অন্তরে অমর-অক্ষয়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক মো: রফিকুল ইসলাম, সভাপতি-শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আরজ আলী স্মৃতি সংসদ, দুর্গাপুর, নেত্রকোণা
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: