ফারজানা মৃদুলা
বাবা মায়ের তিন কন্যার মাঝে ছোট হওয়ায় বড় আদুরে ছিলো গল্পের নায়িকা ফাহমিদা কলি।
এস.এস.সি কেবল শেষ, কত সাতরঙা স্বপ্ন বুনে চলছে মনের ক্যানভাসে। ঠিক সেই ক্ষনেই পারিবারিক সিদ্ধান্ততে বিয়ের পিড়িতে বসতে হলো। তবে সেই সদ্য তরুনি বয়সে পা, রাখা মেয়েটির কিন্তু বিয়ের পর সুখের সঙ্গে দেখা হয়নি। বুঝতে পারলো জীবনসঙ্গী হিসেবে যার হাতে হাত রেখে নতুন করে স্বপ্ন দেখবে সেই মানুষটি তাকে সহধর্মিণীর মূল্য দিতে বড্ড কার্পণ্য করে এবং পরিবারের সকলের কথায় কান দিয়ে খুব অবহেলা করে চলে প্রতিনিয়ত।
অসহ্য মানসিক ও পারিবারিক অত্যাচারের কবলে পড়ে মেয়েটি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।
লেখাপড়া ছিলো যার প্রধান কাজ। যেই মানুষটি ঘরের কাজকর্ম কখন করতে হয়, কিভাবে করতে হয় তা নিয়ে তেমন কোন ধারনাই ছিলো না, সেই কলি শ্বশুরবাড়ী গিয়ে সকলের মন যোগাতে, সেই কাক ডাকা ভোর হতে রাত অবদি যন্ত্রের মত কাজ করেই চলতো।
কখনো স্বামীর সান্নিধ্যে একটু ঘোরাঘুরি কিংবা গল্প করা কি তা টেরও পাইনি। বরং বাবার বাড়ী আসতে হলে ১-২ সপ্তাহ আগে স্বামী নয় শ্বশুর মশাই এর অনুমতি পেতে অলিখিত দরখাস্ত করতে হতো বারবার।
যেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা বর্ননা করতে গিয়ে বলে, মনে হত হাতে নেই হাতকড়া, পায়ে নেই বেড়ী তবুও জেলখানায় বন্দী।
এরই মধ্যে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। তখন যেন -মানসিক অত্যাচারে মাত্রা আরো বাড়তে বসলো, সেই সময় ডাঃ বললো গর্ভের শিশুর ওজন খুবই কম,
পুষ্টিকর খাবার না খেলে বিপদ হতে পারে, কিন্তু খাবারের তালিকায় যে কলির সেই চাহিদা পূরন করা হয় না।
যদিও তার স্বামীর পরিবার বিত্তশালী এককথায় বলা চলে ঢাকার নাম করা এলাকায় প্রপার্টির সংখ্যা হাতে গুনে শেষ করবার নয়।
ভাগ্যের চাকায় যেই বিত্তশালীদের নিন্মমানের মনমানসিকতা দেখে কলি এবং কলির বাবার বাড়ীর লোকের মনে যেন আর্তনাদ করে চলছিলো।
গর্ভকালীন সময়টাতে বাবার বাড়ী থেকে নিয়মিত তার খাবার এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আসতো। তবে অবাক করা বিষয় তার বাবার বাড়ী লোকরাও কোনদিন নূন্যতম সম্মান পায়নি সেই পরিবারটি হতে।
অবশেষে কলির ঘরে জোছনার আলো, ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জননী ফাহমিদা কলি।
কন্যা সন্তান হওয়াতে মা মেয়ে দুজনেই পুরুষ্কার হিসেবে তিরস্কার পেতেই থাকলো প্রতিনিয়ত। সহ্য করতে না পেরে কন্যার বয়স যখন ৫বছর তখন কলির ভেতরে জেগে উঠলো আর নয়......
আমার মেয়েকে নিয়ে সম্মানের সাথে বাঁচবো উপলব্ধি করলো। মেয়েটির জীবন গড়ে তুলতে হবে নিজের হারানো স্বপ্নের মত। আর তখনই সেই সাহসী সিদ্ধান্ত নিলো বিবাহবিচ্ছেদ। শুরু হয় কঠিন পথচলা।
সমাজে একলা মা হয়ে চলা মানে ( সিঙ্গেল মাদার) তবে নিজের পরিবার সেই সময়টাতে যেন এমন করে আগলে নিলো মনে হলো তাদের মা মেয়ের যুগল নতুনভাবে নিজেদের আবিষ্কার করলো প্রজাতির ডানায় ভর করে।
মাতৃত্ব কারও জন্য সহজ যাত্রা নয় এবং দুর্ভাগ্যবশত একক মায়েদের জন্য আরও কঠিন। আমরা নারীদের এগিয়ে যাওয়ার কথা বলি, তাই বলে এটা নয় তারা সহানুভূতির চায় বরং দরকার সমানুভুতি।
সমাজের অনেক দ্বন্দ এবং চাপ রয়েছে যা একক মায়েদের মধ্য দিয়ে যায়, যা অন্য কেউ সরাসরি অনুভব করতে পারে না।
সিঙ্গেল মাদারদের জন্যই এটা আজীবনের চ্যালেঞ্জ। কলি বলে আজ আমার মেয়ে কে নিয়ে ২২ বছরের এই পথচলা। শুরুর দিকে এটাকে খুব কঠিন মনে হতো।
অভ্যস্ত হয়ে গেলে একটা পর্যায়ে সেটা আর কঠিন থাকে না, তবে বিষয়টা চ্যালেঞ্জিং।
আমার পরিবার আমাকে অনেকে সাপোর্ট করেছে।
” থেমে যেতে পারতাম, হারিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু আমি বাঁচতে শিখেছি আমার জন্য, যারা বাঁচতে চায় তাদের জন্য।“
আজ কলি একজন উদ্দোক্তা যদিও প্রথমে চাকুরী করত কিন্তু মনে হলো নিজে কিছু করে নারীদের কর্মসংস্থান করবে, আর সেই তালিকায় অব্যশই প্রাধান্য থাকবে সিঙ্গেল মাদারদের। বাংলাদেশে এখন বাড়ছে একা মায়ের সংখ্যা।
এছাড়া এমন অনেক মায়েরাও আছেন যাদের স্বামী মারা যাওয়ার পর শুধুমাত্র সন্তানের জন্যই একা থেকে গেছেন। তাদের একা পথচলা, সন্তান পালনের সংগ্রামের গল্পে নিজেকে যুক্ত করতে পারলেই হবে তার জীবনের স্বার্থকতা।
এ ক্ষেত্রে একক মায়েদের র্ধৈহ্য, সহশীলতা, মানসিক শক্তি এবং স্থিতিশীলতা অবিশ্বাস্যভাবে প্রশংসনীয়। যেমন বেস্ট-সেলিং লেখিকা বারবারা কিংসলভার বলেছেন, "কখনও কখনও মাতৃত্বের শক্তি প্রাকৃতিক নিয়মের চেয়ে বেশি।"
সেই উক্তিকে লালন করে কলি আজ স্বাবলম্বী। আজ আর কারাগারে নয়, মা মেয়ে দুজনেই যেন ইচ্ছেডানায় ভর করে ছুটে চলছে।
মনে ছিলো জেদ সেই কষ্টের সময়গুলোর স্মৃতি তাকে শক্তিশালী করে তুললো।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: