• ঢাকা
  • শনিবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ০৫ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

অটিজম এবং বাংলাদেশ প্রেক্ষিত


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ০২ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১০:৫৫ এএম
বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
অটিজম আক্রান্ত শিশু

অলোক আচার্য

বিশ্ববিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী সিটফেন হকিন্সের কথা আমরা সকলেই জানি। তার বিগ ব্যাং থিওরি রীতিমতো মহাবিশ্বের রহস্যের দ্বার উন্মোচনের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তিনি ছিলেন অটিজমে আক্রান্ত বিশেষ শিশু। উপযুক্ত পরিবেশে তার মেধাকে বিকশিত করেছে এবং তার সেই মেধা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। অটিজম মস্তিস্কের বিকাশগত একটি সমস্যা। অন্য আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর তুলনায় এই রোগে আক্রান্ত শিশুর আচরণ আলাদা হয়। আমাদের দেশে অসচেতনতার কারণে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি অটিজমে আক্রান্ত শিশুর বড় হয়ে ওঠার পরিবেশ তা প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছে। আমাদের সমাজের বহু স্থানে অটিজমে আক্রান্ত শিশু দেখতে পাই। তাদের সাথে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, তাদের বিকাশের সুযোগ প্রদানের জন্য কেমন পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন আমাদের সমাজে তা অনেকের কাছেই অজানা। বিশেষ করে সমাজের একটি অংশ যারা শিক্ষিত নয়, আবার অল্প শিক্ষিত হলেও কারও অটিজম বিষয়ে সুষ্পষ্ট ধারণা নাও থাকতে পারে। 

অতীতে কিছু ভ্রান্ত ধারণা ছিল এবং সেগুলো আজও রয়েই গেছে। এর ফলে অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা তাদের বিকাশে যথাযথ পরিবেশ পায় না। অথচ অটিজমে আক্রান্ত হওয়া তাদের দোষ নয়। তারা আর দশটা শিশুর মতোই বড় হয়ে ওঠার পরিবেশ পাওয়ার অধিকার রাখে। অটিজমে শিশুর একটি অবস্থা যখন তার বড় হয়ে ওঠা অন্য স্বাভাবিক শিশুর তুলনায় ধীর গতির হয়। শিশুটির সামাজিক বিকাশ ঠিকমতো হয় না। অন্য শিশুর সাথে স্বাভাবিকভাবে মেশা বা খেলাধূলা অটিজমে আক্রান্ত শিশু করতে পারে না। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় বাধা হলো অভিভাবকের সচেতনতার অভাব,অবহেলা এবং প্রচলিত কুসংস্কার। এসব কারণেই এখনও গ্রামাঞ্চলে অটিস্টিক শিশুকে অবহেলার শিকার হতে হয়। অটিজম মূলত হলো অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার বা সংক্ষেপে এএসডি। 

স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ বিকল হলে হতে পারে এমন রোগ। এমন হলে শব্দ, অঙ্গভঙ্গি, মুখের অভিব্যক্তি বা স্পর্শের মাধ্যমে ভাব প্রকাশে করা তাদের পক্ষে হয় কঠিন। আচরণের হতে পারে পুনরাবৃত্তি। আর আগ্রহ সীমিত হয়ে আসে। তাদের কারও কথোপকথনে সমস্যা, তবে অন্য দক্ষতা থাকে। বাংলাদেশে অটিজমের বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে, এ বিষয়ে দেশব্যাপী চালানো জরিপে দেখা গেছে, ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে অটিজমের শিকার প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন।

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস প্রস্তাবটি ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হয়েছিল এবং সেটি গৃহীত হয়েছিল একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর। বিশ্ব অটিজম দিবস স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জাতিসংঘের সাতটি দিবসের মধ্যে অন্যতম। গতবছর অটিজম দিবসে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজ অর্ডার অ্যান্ড অটিজম দেশব্যাপী জরিপ চালানো জরিপে দেখা যায়, ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে অটিজমের শিকার প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন। একটি শিশু অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বা অটিজমে আক্রান্ত কি না তা শিশুর জন্মের পর বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে তার আচরণ এবং অন্য স্বাভাবিক শিশুর মতো তার বিভিন্ন লক্ষণের সাথেই বোঝা যায়। তবে সবার ক্ষেত্রে অটিজমের লক্ষণ একই রকম হয় না। এরা একই কাজ বারবার করতে চায়। একটি নির্দিষ্ট জিনিসের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকে। আজও আমাদের সমাজ যে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে সেখানে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে অবহেলা আর অনাদর জোটে। কারণ সামাজিকভাবে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর মাকে পারিবারিকভাবে এবং সামজিকভাবে অসম্মানজনক কথা শুনতে হয়। সংসারে নেমে আসে অশান্তি। পরিবারের অন্য সদস্যদের সমর্থন থাকে না। এর ফলে যা ঘটে তা হলো সেই শিশুটির ভেতর যে মেধা রয়েছে তা বিকশিত হতে পারে না। কারণ অটিজমে আক্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো পারিবারিক সমর্থন। পরিবারের সমর্থনের পর সামাজিকভাবে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি এবং বিদ্যালয়ে তার বিকাশের পরিবেশ তৈরি হয়। সেই পারিবারিক সমর্থন আমাদের দেশে বিশেষভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে খুব কম। যদিও এদের জন্য ক্রমেই মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অটিজম সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল সেসব ক্রমেই দূরীভুত হচ্ছে। একসময় মনে করা হতো এই শিশুরা সমাজের জন্য কোনো অবদান রাখতে পারবে না। কিন্তু এখন শিক্ষা প্রসারের সাথে সাথে আমরা জানি যে এসব শিশুর মধ্যে মেধা রয়েছে এবং বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বিকাশ ঘটে। প্রতি বছর এপ্রিলের ২ তারিখ আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস প্রস্তাবটি ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হয়েছিল এবং সেটি গৃহীত হয়েছিল একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর। গত বছরেও যখন এই দিনটি পালিত হয় তখন ছিল করোনা ভাইরাসের তীব্রতা। এবং এবছরেও যখন এই দিনটি এসেছে তখনও করোনা ভাইরাসের মহামারীর তান্ডব চলছে। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের জীবনই যেখানে দুরুহ হয়ে উঠেছে সেখানে এসব অটিজমে আক্রান্তদের জীবন আরও নাকাল হয়ে উঠেছে। 
বাংলাদেশ অটিজম-সংক্রান্ত কার্যক্রম এগিয়েছে অভাবনীয়ভাবে। ১৪টি মন্ত্রণালয় নিয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় টাস্কফোর্স। ৮টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি। এর মধ্যে প্রথম সারির ৫টি হলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশে অটিজম-সংক্রান্ত বেশকিছু চিকিৎসা সহায়তাকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে যেমন- ইনস্টিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো-ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা; জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, চাইল্ড গাইডেন্স ক্লিনিক, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা; ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শিশু বিকাশ কেন্দ্র, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ঢাকা; প্রয়াস বিশেষায়িত স্কুল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট; মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশুরোগ বা মনোরোগবিদ্যা বিভাগ; নিকটস্থ জেলা সদর হাসপাতাল বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স; সরকার অনুমোদিত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও বিশেষায়িত স্কুল; প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। অটিজমে আক্রান্ত একটি শিশুকে তার মেধার সাথে পরিচয় করাতে হলে তার সাথে আচরন সহজ ও বন্ধুত্বপূর্ণ করতে হবে। তাকে সময় দিতে হবে। তার পছন্দ,অপছন্দ,ভয় পাওয়া, উত্তেজিত হওয়া এসব বিষয়ের সাথে পরিচিত হতে হবে। এ ধরনের শিশু কিছু কিছু বিষয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠে আবার কোনো জিনিস সে খুব পছন্দ করে। এসবের সাথে পরিচিত হলে তার সাথে মিশতে পারার কাজটি সহজ হয়ে ওঠে। কেউ ভালো ছবি আঁকতে পারে, কেউ বা অন্য কোনো কাজে দক্ষ হতে পারে। এই দক্ষতার বিষয়টি তাকে উৎসাহিত করে। সে আরও বেশি মনোযোগী হয়। একসময় দেখা যায় সে অনেক বড় কোনো কাজে অবদান রাখতে পেরেছে।

একসময় আমাদের দেশে শারীরিক প্রতিবন্ধী, অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রতি সমাজের সর্বত্রই ছিল অবহেলা। খুব বেশি হলে তাদের জন্য ছিল করুণা। সেই ধারণার যে খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে তা নয়। তবে মানুষ শিক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে এবং অটিজম সম্পর্কে জানার কারণে সেই ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর প্রতি আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা উচিত সেটা বুঝতে পারছি আমরা সবাই। বাড়িতে এবং বিদ্যালয়ে অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে উপযুক্ত পরিবেশ দিলে তার মেধা বিকশিত হবে এবং সমাজে সেও অবদান রাখতে পারবে। কিন্তু তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তার চিকিৎসা হবে দীর্ঘমেয়াদী। সঠিক চিকিৎসা এবং যত্ন পেলেই সে তার মেধা বিকাশ ঘটাতে পারবে। 
 

ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন

আরো পড়ুন

banner image
banner image