অলোক আচার্য
শ্রম, শ্রমিক এই দুয়ের উপরেই আজকের আধুনিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের সুউচ্চ অট্রালিকা শ্রমিকদের ঘামের উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে তাজমহলকে নিয়ে আজ বিশ্বের এত মাতামাতি সেই তাজমহল তৈরিতে লেগেছে শ্রমিকদের ঘাম। অথচ আজকের সমাজে যেন কুলি-মজুর এবং সাহেব এই দুই শ্রেণিতে ভাগ হয়ে গেছে। সভ্যতা যতই অগ্রসর হচ্ছে ততই এই বিভাজন শক্ত হচ্ছে। এই পার্থক্য গড়ছে অর্থ। যার অর্থ আছে সে মালিক। আর যার নেই সেই শ্রমিক!
শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু হয়েছিল কর্মঘন্টাকে কেন্দ্র করে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত বহু জল গড়িয়েছে। শ্রমিকের কর্মঘন্টা কমেছে। তবে এখনও অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়। কথায় কথায় ছাটাইয়ের শিকার হয়। নারী শ্রমিকের দুর্দশা তো আরও একধাপ এগিয়ে। কাজ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয় অনেকে। তারপর বেতন বৈষম্য তো থাকেই।
১ লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস যা মে দিবস নামেই বেশি পরিচিত। এর পেছনে রয়েছে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সর্বোচ্চ আতœত্যাগের ইতিহাস। যে ইতিহাস আজও সেদিনের স্মৃতি বহন করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকদের কর্মঘন্টা নিয়ে অসন্তোষ ছিল বহুদিনের। কম মজুরিতে দীর্ঘক্ষণ ধরে কাজ করানো হতো তাদের দিয়ে। এর ফলে তাদের মাত্রাতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করতে হতো। এই কাজের সময়কাল ছিল ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা। শিল্প মালিকরাই বেশি লাভ ভোগ করতো। ফলে শ্রমিকদের জীবন ছিল মানবেতর। ১৮৬০ সালে শ্রমিকরা তাদের মজুরি না কমিয়ে দিনে আট ঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি জানান। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক আট ঘন্টা কাজের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এই দাবিতে ১৮৮৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে শ্রমিকদের আন্দোলন এবং এর প্রেক্ষিতে শ্রমিকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে পুলিশসহ ১০-১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
দেশের বিভিন্ন খাতে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করছেন শ্রমিকরা। ২০২২ সালে দেশে কর্মরত ছিলেন ৭ কোটি ৪ লাখ শ্রমিক। তাদের মধ্যে ৩২ শতাংশ শ্রমিক ধুলো, শব্দ ও কম্পনের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কর্মরত ছিলেন। প্রায় ৭ শতাংশ শ্রমিক রাসায়নিক বিস্ফোরক দ্রব্যের সঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। আগুন ও গ্যাসযুক্ত পরিবেশে কাজ করেন ৫ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমিক। আর তাদের প্রায় ৪ শতাংশ মাটির নিচে বা অধিক উচ্চতায় কর্মরত আছেন। দেশে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকদের প্রায় ৮৭ শতাংশ পুরুষ ও বাকি ১২ শতাংশ নারী। জরিপ বলছে, ২০২২ সালে জাতীয় পর্যায়ে মোট শ্রমিকের প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৬২ শতাংশ শ্রমিক কমপক্ষে একবার, ২৫ শতাংশ দুইবার এবং ৮ শতাংশ শ্রমিক তিনবার দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এক বছরে প্রায় ২ শতাংশ শ্রমিক ৫-৯ বার পর্যন্ত দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। গত বছরের ডিসেম্বরে গণমাধ্যমে প্রকাশতি প্রতিবেদনে, ‘বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেইফটি, হেলথ অ্যান্ড অ্যানভায়রনমেন্ট (ওশি) ফাউন্ডেশন একটি বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর দেশের বিভিন্ন শ্রম খাতে ১ হাজার ৪৩২ শ্রমিকের প্রাণ গেছে। গত বছরের তুলনায় এবার শ্রমিকদের প্রাণহানি বেড়েছে ৪৮ শতাংশ; সবচেয়ে বেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে পরিবহণ খাতে।সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রে নিহত হয়েছিলেন ৯৬৭ শ্রমিক, আহত হন ২২৮ জন। কিন্তু ২০২৩ সালে মারা যান ১ হাজার ৪৩২ জন, আহত হন ৫০২ জন।
১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামে সমাজতন্ত্র পন্থীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে শ্রমিকদের দাবি দাওয়া প্রস্তাব আকারে গৃহিত হয়। সেই সভাতেই বিশ^ব্যাপী সমাজতান্ত্রিক দলগুলো এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে প্রতি বছরের ১ মে শ্রমিকদের আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল ও শোভাযাত্রা বের করার আহবান জানানো হয়। সেই সাথে শ্রমিকদের এদিন সব ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। এক পর্যায়ে ন্যায্য মজুরি এবং দৈনিক আট ঘন্টা কর্মঘন্টার শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এখন এই দিনটি সারাবিশে^ ব্যপকভাবে পালিত হয় এবং দিনটিকে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের,ন্যায্য পাওনা আদায়ের এবং দাবি দাওয়া পূরণের হাতিয়ার হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
আজ যখন সারা পৃথিবীতে করোনার মহামারী চলছে, যখন সবকিছু বন্ধ তখন আমরা বেতনের দাবিতে কতিপয় গার্মেন্টেসের শ্রমিককে রাস্তায় বিক্ষোভ করতে দেখেছি। আমরা যখন ঘরে নিরাপত্তা খুঁজছি, সেসব শ্রমিক রাস্তায়।
এরা আমাদের দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তাদের হাতেই, তাদের ঘামেই দেশের উন্নয়নের ইট গাঁথা হচ্ছে। যত বড় বড় স্থাপনা হয়, অবকাঠামো হয় সেগুলো তৈরি করে যারা তারাই তো সেই মহান মানুষগুলো। তাজমহল বানানোর পর সবাই তার জন্য বাহবা দেয় স¤্রাট শাহজাহানকে। অথচ একটু গভীরে গেলেই দেখা যাবে এই তাজমহল তৈরি করতে গিয়ে কত শ্রমিকের ঘাম ঝরানো আছে। সেসব মানুষকে কেউ মনেও রাখেনি। প্রশংসা যেন তাদের প্রাপ্য নয়। সবাই স¤্রাটকেই বাহবা দেয়! যদি শ্রমিকের ঘাম না ঝরতো তাহলে কোথায় থাকতো এই সুনাম? আজকের সভ্যতার প্রতিটি উন্নয়নের পেছনেই রয়েছে এই কুলি শ্রেণির মানুষের অবদান। আমরা সেই অবদান টাকা দিয়ে পরিশোধ করতে চেয়েছি মাত্র। তাও অনেক সময়ই তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সমাজের স্যুট বুট পরা বাবু সাহেবদের কাছে ঘামে ভেজা মানুষের দাম কোনোকালেই ছিল না। আমরা তাদের মূল্যায়ন কোনোদিনই করতে পারিনি। অথচ আজকের সভ্যতার চারদিকে তাকালে যে বিলাসবহুল অট্রালিকা চোখে পড়ে,বড় বড় ইমারতে চোখ ধাধিয়ে যায়, যে নির্মাণশৈলি আমাদের মনে কবিতার পঙতি এনে দেয় তার পেছরে রয়েছে হাজার হাজার শ্রমিকের দু’হাতের শ্রম। আমরা কেবল এসব ইমারতের মালিককেই প্রশংসায় ভাসাই। পেছনে পরে থাকে এসব শ্রমিকের ইতিহাস। আমরা ভুলে যাই যে সভ্যতার রুপায়ণ ঘটেছে শ্রমিকের হাতুড়ির আঘাতে। অথচ সেই হাতুড়ির সঠিক মূল্য আমরা কোনোদিনই দিতে চাইনি। তারা বারবার অধিকার হারা হয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে তাই অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হয়। আজ শ্রমিকদের জন্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা গেলেও আজও তাদের কাজের স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা বিধান করা যায়নি। বিভিন্ন খাতে যে শ্রমিক কাজ করছে তাদের ন্যায্য পাওনার সাথে প্রতিটি কাজেই উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মে দিবস শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ স্বাক্ষী। তাদের কাজের ন্যায্য মূল্য আদায়ের ঐতিহাসিক এই দিনটিকে স্মরণে রেখে তাদের ন্যায্য পাওনা দিতে হবে।
প্রতিটি শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা পাক, তারাও নির্দিষ্ট সময় কাজ করুক এবং সম অধিকার ভোগ করুক।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: