
ফারজানা মৃদুলা
তিন ভাই বোন এর মাঝে ২য় স্থানে মানে আমরা যাকে মেজো বলে থাকি সম্মোধনের দিক থেকে, নানী দাদীদের মুখে শুনতাম মেজোরা বেশ রগচটে হয়, দুষ্টও হয় বটে। তবে এই গল্পের মূল যিনি তিনি কিন্তু মেজো হলেও ছোটবেলা থেকেই খুব শান্ত, নরম কোমল মনের অধিকারী।
বড়বোন স্নিগ্ধা চৌধুরী ছিলো বড়ই দূরন্ত এখন অবদি লোকে তার দুরন্তপনার কারণে ছোট বলেই মনে করে এই গল্পের মূল চরিত্রর কাছে।
ছোটভাই সজীব চৌধুরী বাবা বীরমুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী, জীবনের একটা সময় সুদূর প্রবাস দুবাই তে কাটিয়েছিলেন বেশ সময়।মা শিরিন সুলতানা চৌধুরী ছিলেন গৃহীনি।মায়ের কাছ থেকে শিখেছে, সংসার কিংবা বাহিরের কাজ গুলো কত সুন্দর করে সামলানো যায় পরম মমতা দিয়ে।
তখন বাবা প্রসাধনী সামগ্রী পাঠাতেন কন্যাদের জন্য ,আর সেই প্রসাধনী গুলো নিজের সমবয়সী সাথীদের যারা এইগুলো সৌখিন প্রসাধনী গুলো ক্রয় করতে পারতোনা, তাদের মাঝে বিলিয়ে দিতো। আসলে মূল কথা হলো অন্যের মুখের হাসি ফোটানো যার নেশা সেই গল্পের নায়িকা হলো শাহনাজ চৌধুরী।
দেশের বাড়ী ঢাকার নবাবগঞ্জ হলেও বেড়ে ওঠা মগবাজার ।লেখাপড়ার প্রতি প্রবল ইচ্ছে ছিলো এবং একজন চিকিৎসক হবার বাসনা মনে লালন করতেন। কিন্তু এসএস সি দেবার পরই ১৯৯৬ সালে অষ্টাদশী তে পা রাখা শাহনাজের বিয়ে হয়ে গেলো!
নিজের চুল বাঁধা থেকে ধরে মুখে তোলে খাইয়ে দিতো মা , সেই মানুষ টি বিয়ের পরই নতুন জীবন শরু করে আফ্রিকাতে।
জীবনসঙ্গী সরদার এ. রাজ্জাক এর ভালোবসা তার নতুন জীবনের আতংকটা যে ফানুসের মত হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো। ১ম পুত্রসন্তান কে নিয়েই এইচ এস সি পরীক্ষায় অংশ নিলো।কেননা লেখাপড়ার বিষয়ে নিজেকে কোন ছাড় দিবেন না এই শপথ করে নিলো। এরপর ২য় পুত্র কোল জুড়ে এসে সংসার যেন আলোকিত করে তুললো।এরপর মাষ্টার্স শেষবর্ষেে এবং মজার বিষয় হলো ২০০৮ এর ১০ই আগষ্ট সেই পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো এবং কোল জুড়ে এলো আরেক পুত্র সন্তান রাফান চৌধুরী ।
যার অনুপ্রেরনা শত রাফানের মা করে তুলেছে শাহনাজ চৌধুরীকে। জীবনের যুদ্ধ কাকে বলে সেই উপলব্ধি করেছে রাফানের জন্মের পর। শরীরের কোষসমূহে ২১তম ক্রোমোজমে একটি অতিরিক্ত ক্রোমোজম বা ট্রাইজোমি ২১ বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয় রাফান। এই বৈশিষ্ট্য সমূহদের বলা হয় ডাউন সিনড্রোম।ডাক্তার এর মুখ থেকে এমন খবরটি শোনার পর নিজেদের মনোবল কে শক্ত করলো কিন্তু মনটায় হতাশার জাল যেন বাসা বাঁধতে চায় প্রতিনিয়ত।
জীবনসঙ্গীর সাহস দিলো বললো এই যাত্রায় আমিও তোমার সঙ্গী প্রতিটাক্ষনের। ভয় নেই ইনশাআল্লাহ আমরা পারবো। কিন্তু পাছে লোকের কটু কথা যে একদম শুনতে হয় নি তা নয়, রাফানকে নিয়ে পথচলাটা মসৃন ছিলো না তবে, শুভাকাঙ্ক্ষীরা ছিলো পাশে।
ছোট এই চাঁদমুখটা যেন আশার আলো দেখায়।বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রোম আর অটিজমকে একই কাতারে বিবেচনা করা হত বা এখনো হয়। এই ধারাকে বদলাতেই হবে। এই প্রত্যয়কে নিয় শুরু করলো নানা রকম তথ্য সংগ্রহ করা। বাংলাদেশে এই নিয়ে কোন জায়গাই ছিলো না জানার । ইন্টারনেট কে পুঁজি করে এই বিষয়ে সব ধারণা নিয়ে ২০১৪ সালের ২১শে মার্চ বিশ্বে নবম এবং বাংলাদেশে ১ম বারেরমত উদযাপন করেন ডাউন সিনড্রোম সচেতনতার মাস এবং এরপর আর পিছু ফিরে থাকাতে হয়নি। ডাউন সিনড্রোম বিষয়ে সব ধারনা নিয়ে বাংলাদেশে ১ম ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি অফ বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করে।
এর পিছনে মূল লক্ষ্য ছিলো রাফানের মত বৈশিষ্ট্যের শিশুগুলো যেন অটিজমের কাতারে মিলিয়ে তাদের প্রতিভা গুলো ধুলোয় না মিশে। শাহনাজ জেনে গেছে যে তারা সব পারবে তবে কিছুটা দেরীতে এজন্য দরকার আলাদা জায়গা, যেখানে এই পুতুলের মত মুখগুলো যেন আদর যত্নে ভালোবাসায়, নিজেদের মেধা গুলো কে ফুটিয়ে তুলতে পারে।
কারো বোঝা হয়ে নয় বরং সমাজের অংশ হয়ে সম্মানের সাথে জীবন পরিচালনা করতে পারে।এখন ২০২৩ শাহনাজ চৌধুরী ১টি রাফান নয় শত রাফানের গর্বিত মা।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: