আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গত সপ্তাহে বার্বাডোজের প্রধানমন্ত্রী মিয়া মোটলিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, জাতিসংঘের মহাসচিব পদে লড়ছেন কিনা? জবাবে মুখে হালকা হাসি মেখে হাত উঁচিয়ে সবাইকে সম্ভাষণ জানিয়ে বের হয়ে যান তিনি। জাতিসংঘের ভেতরের লোকজন বলাবলি করছেন, সংস্থাটির পরবর্তী মহাসচিব পদে লড়াইয়ে এগিয়ে আছেন তিনি। এই নারী সবার পছন্দের তালিকায়ও আছেন।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই সংস্থার শীর্ষ পদের জন্য বাছাই-প্রক্রিয়া শুরু হতে এখনো অনেক সময় বাকি আছে। ২০২৬ সালে। কিন্তু কারা এ পদে এগিয়ে আছেন, সে নিয়ে গুঞ্জনের শেষ নেই। কিন্তু বেশির ভাগই ইঙ্গিত দিচ্ছেন মোটলির দিকে।
ঐতিহাসিকভাবেই পদটির জন্য একটি অঞ্চল থেকে একবার কেউ মহাসচিব হলে পরেরবার অন্য অঞ্চল থেকে কেউ হবেন বলেই ধরে নেয়া হয়। বারবার একই অঞ্চল থেকে মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা নেই।
একারনে জাতিসংঘের পরবর্তী নেতা দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা ক্যারেবীয় অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হওয়ার কথা। সবাই বলছেন, এখন একজন নারী মহাসচিব দরকার। গত ৭৮ বছর ধরে কেবল পুরুষরাই দখল করে রেখেছেন এ পদ। যে কারণে সবাই একটি পরিবর্তন দেখতে চাচ্ছেন (খবর সংবাদমাধ্যম সিএনএন )।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন আলোচনায়ও মহাসচিব পদে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে মিয়া মোটলির কথা উঠে আসে। সূত্র জানিয়েছে, কলোম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও শান্তিতে নোবেলজয়ী হুয়ান মানুয়েল সান্তোস শিগগিরই মহাসচিব পদের লড়াইয়ে প্রচারে নামবেন। যদিও এমন দাবি অস্বীকার করেন সান্তোসের এক প্রতিনিধি।
এছাড়াও আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার মহাপরিচালক ও আর্জেন্টিনার কূটনীতিক রাফায়েল গ্রোসির নামও শোনা যাচ্ছে। জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব হিসেবে অ্যান্থনিও গুতেরেসের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তার।
আলোচনায় রয়েছেন মেক্সিকোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালিসিয়া বারসেনা, কোস্টারিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘের উচ্চ-পর্যায়ের কর্মকর্তা রেবেকা গ্রিনস্প্যান, ইকুয়েডরের সাবেক মন্ত্রী ও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সাবেক সভাপতি মারিয়া ফার্নান্দো এসপিনোসা গার্সেস।
নেতৃত্বের ক্যারিশমা ও স্পষ্টভাষিতার কারণে জাতিসংঘের মহাসচিব পদে মিয়া মোটলির নাম উচ্চরণে আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করছে। বৈশ্বিকভাবে তিনি এরইমধ্যে সাড়া জাগাতে পেরেছেন। তার নামের মধ্যেই যেন একটা অনুপ্রেরণা কাজ করছে।
এ পর্যন্ত মোটলিকে কখনো বলতে দেখা যায়নি যে তিনি প্রার্থী হতে যাচ্ছেন। জাতিসংঘের একজন কূটনীতিক বলেন, মিয়া মোটলি যদি প্রার্থিতার ঘোষণা দেন, তবে আমি আনন্দে নেচে উঠবো। এভাবে বেশিরভাগই মানুষই চাচ্ছেন এই নারী যেন লড়াইয়ে নামেন।
বার্বাডোজের প্রতিবেশী সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডাইনসের প্রধানমন্ত্রী রালফ গনসালভেস বলেন, মোটলি যদি প্রচারে নামেন, তাহলে তাকে আমি ভোট দেব। আমি মনে করি, তিনি মহাসচিব পদের জন্য উপযুক্ত। তিনি যা-ই করেন না কেন, তার প্রতি আমার সমর্থন থাকবে।
২০১৮ সালে বার্বাডোজের প্রধানমন্ত্রী হন মিয়া মোটলি। পরে দ্বিতীয় মেয়াদেও ভূমিধস বিজয়ী হন তিনি। ব্রিটিশ রাজতন্ত্র থেকে উপনিবেশ-পরবর্তী সম্পর্কোচ্ছেদ করে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় আসেন মোটলি।
দাসত্বের ক্ষতিপূরণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিভিন্ন বহুপাক্ষিক ব্যাংকের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠাগুলোর সংস্কার নিয়ে তার বক্তব্য আলোড়ন তুলেছে।
মোটলি যখন কথা বলেন, তখন তাতে অস্পষ্টতার কিছু থাকে না। এমনকি বড় বড় ক্ষমতাধর দেশকেও তিনি পাত্তা দেন না। তার এই সাহসই তাকে বিশ্বজুড়ে পরিচিত করে তুলেছে।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, ভেনিজুয়েলার তেল ও গ্যাস কেন শেভরন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেবে? অথচ ভেনিজুয়েলা ৩৫ শতাংশ ছাড়ে তেল ও গ্যাস দেয়ার প্রস্তাব দিলেও তা পাচ্ছেন না ক্যারিবীয়রা।
২০২২ সালে ব্রিজটাউন উদ্যোগের নেতৃত্ব দেন মিয়া মোটলি। জলবায়ু পরিবর্তনসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রতিকূলতা সামনে রেখে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো ও উন্নয়ন অর্থনীতিকে আরও ন্যায়সঙ্গত করতে এই রাজনৈতিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।
এপ্রিলে জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে এক যৌথ উদ্যোগে যোগ দেন তিনি। এ সময়ে তার ব্রিজটাউন ২.০ নামের উদ্যোগ সংস্কারের ঘোষণা দেন মোটলি। উন্নয়ন অর্থনীতির জন্য ছয়টি উন্নয়ন অগ্রাধিকারের কথা তুলে ধরেন। আগামী অক্টোবরে মরোক্কোয় আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বার্ষিক সম্মেলন, নভেম্বরে দুবাইতে কপ২৮ ও ২০২৪ সালে দ্যা সামিট অব দ্য ফিউচারে এ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
জাতিসংঘের একজন কূটনীতিক বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে মোটলির মতো সাম্প্রতিক ইতিহাসে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ছাড়া আর কোনো নেতার সক্ষমতা আছে বলে আমি করি না। তিনি যেভাবে রাজনৈতিক ঝুঁকি নিচ্ছেন, তা নিয়ে অনেককে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
নিউইয়র্ক সিটি ও তার বাইরের অনেক কূটনীতিক বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলো যেসব প্রতিকূলতার মুখোমুখি, জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে তা মোকাবিলায় ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা আছে মোটলির মধ্যে। নেতৃত্বের এক অনন্য বৈশিষ্ট আছে তার।
আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ রিচার্ড গোয়ানও বলছেন একই কথা। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় রেখে পরবর্তী পদক্ষেপে সতর্কভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে মোটলিকে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের যে কোনো একটির ক্ষোভের মুখে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে মোটলির। আর জাতিসংঘের মহাসচিব নির্বাচনে তাদের কথাই চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করা হয়।
জাতিসংঘের মহাসচিব কেন নারী নয়?
জাতিসংঘের প্রায় আট দশকের ইতিহাসে কোনো নারীকে মহাসচিব করা হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, যা অনেক আগেই করা উচিত ছিল। আর সেটা হতে হবে মেধার ভিত্তিতেই।
সংস্থাটির পরবর্তী মহাসচিব ২০২৭ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেবেন। বছর চারেক আগেই নতুন মহাসচিব কে হচ্ছেন, সেই আলাপ জমানো একটি বেশিই আগাম হয়ে যাচ্ছে না? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।
যে সংস্থাটি একটি সন্ধিক্ষণ পার করছে, সেটি নিয়ে এই আলোচনা দরকারি বলেই মনে করেন অনেকে। এমনিতেই জাতিসংঘ নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই। তারপরে ক্ষমতাধর নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে। ভেটো ক্ষমতার কারণে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে অনেক দেশ।
ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিনা ভ্যালটোনেন বলেন, জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব নিয়ে যে আলোচনা উঠেছে, সেটি খুব আগেভাগে হচ্ছে বলে আমি মনে করি না। কারণ, জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদের ভবিষ্যত কেমন হবে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কাজেই সংস্থাটির মহাসচিব নিয়ে এখনই আলোচনা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, একজন নারীকে জাতিসংঘের মহাসচিব করার সময় অনেক আগেই হয়েছিল। তবে অবশ্যই পদটি মেধাভিত্তিক। যিনিই এখানে বসবেন, তার সেই মেধা থাকতে হবে। একজন নারী বলেই কাউকে মহাসচিব করা হবে, এমন না। তার সেই মেধা আছে বলেই তিনি পদটিতে বসবেন।
বাছাই-প্রক্রিয়া
মহাসচিব বাছাই-প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে গোপনীয় ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে কিছুটা প্রকাশ্যে চলে আসে। প্রথমত, কোনো একটি দেশ–সচরাচর নিজ দেশ–প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবে। পরে সেই নামের সুপারিশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে সাধারণ পরিষদে পাঠানো হয়।
২০১৬ সালের বাছাই-প্রক্রিয়ায় কয়েকটি দেশ কেবল নারী প্রার্থীর নাম প্রস্তাব দেয়ার কথা জানায়। এই প্রবণতা আগামীতেও চলমান থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০১৬ সালে মহাসচিব পদে ১৩ প্রার্থী লড়েছেন। তাদের মধ্যে সাতজন ছিলেন নারী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অ্যান্থনিও গুতেরেস মহাসচিব নির্বাচিত হন। দীর্ঘদিন ধরেই ধারণা করা হচ্ছিল যে পর্তুগিজ এই কূটনীতিক জাতিসংঘের শীর্ষ পদটিতে বসবেন।
যুক্তরাজ্যের জাতিসংঘ অ্যাসোসিয়েশনের ক্যাম্পেইনপ্রধান বেন ডোনাল্ডসন বলেন, এখন পর্যন্ত বহু পুরুষ প্রার্থী হতে চেয়েছেন। কিন্তু চলতি সময়ে এসে বেশিরভাগ দেশ ও সুশীল সমাজের উচিত কোনো পুরুষকে জাতিসংঘের মহাসচিব প্রার্থী না করা। কেবল নারীকেই এ পদের জন্য বাছাই করা উচিত। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি, সফল হওয়ারও প্রত্যাশা রয়েছে।
২০১৬ সালে প্রার্থী হয়েছিলেন সুসানা মালকোরা। আগামীতে নারী প্রার্থী দেয়ার জন্য রাজনৈতিক চাপ তৈরিতে কাজ করছেন অ্যাডভোকেসি গ্রুপ গ্লোবাল উইমেন লিডার্স ভয়েসেসের এই সভাপতি।
তিনি বলেন, জুলি, অ্যানে কিংবা ম্যারিকে নিয়ে আমরা আলোচনা করছি না। আমরা কথা বলছি একজন নারী মহাসচিবকে নিয়ে। আর এ জন্য পথ তৈরি করতে আমাদের সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে।
জাতিসংঘের ৭৮তম সাধারণ পরিষদের সভাপতি ডেনিস ফ্যান্সিস বলেন, পুরুষদের প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখার পক্ষে আমি না। আমি মনে করি, আগামীতে পুরুষরা যেমন প্রার্থী হবেন, তেমনই বিপুল সংখ্যক নারীও লড়বেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব পদে কেবল নারীদের মধ্যে লড়াই হলে তা ভুল বার্তা দেবে বলে মনে করেন ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর এই কূটনীতিক।
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: