• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ০৫ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

সুশীল সমাজ অকার্যকর কেন?


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ০৬:৩৮ পিএম
সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক নৈরাশ্য
সুশীল সমাজ

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

মানুষ সমাজে বাস করে, সেখানে আজ কোনো নিরাপত্তা নেই। না আছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, না দৈহিক। রাষ্ট্র তার কর্তব্য পালন করতে পারছে না। উপরন্তু তার পুলিশ, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ কেউ নিরাপত্তা দেয় না; বরং মানুষের জন্য ভীতির কারণ হয়। অন্যদিকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত সন্ত্রাস ঘটছে রাষ্ট্রের ঔদাসীন্য, আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতায়। সন্ত্রাসীদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি এগোচ্ছে অরাজকতার দিকে। সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক নৈরাশ্য।

এই অরাজক পরিস্থিতির অভ্যন্তরে সমাজে যা ঘটছে তা হলো, শ্রেণিকর্তৃত্বের আধিপত্য বৃদ্ধি। এই বিশেষ শ্রেণিকে আগে আমরা মধ্যবিত্ত বলতাম, এখন তাকে বিত্তবান বলাই সংগত। কেননা, মধ্যবিত্ত এখন আর অবিচ্ছিন্ন নেই; তার একাংশ নেমে গেছে নিচে, অন্য অংশ উঠেছে উঁচুতে। বিত্তবান এই শ্রেণিটিই এখন দেশের সর্বময় কর্তা। এরাই আমলা, এরাই ব্যবসায়ী। রাজনীতিও এরাই করে, শিল্প-সংস্কৃতিও রয়েছে এদের নিয়ন্ত্রণে; যদিও এদের সংখ্যা জনগণের তুলনায় শতকরা পাঁচজনের বেশি হবে না। এই শ্রেণির মধ্যে দেশপ্রেম নেই, এর সদস্যরা গণতন্ত্রেও বিশ্বাস করে না। রাষ্ট্রের উত্থান-পতন, সরকারের রদবদল– সবকিছুর ভেতরে অব্যর্থ রয়েছে এই শ্রেণির শক্তি সঞ্চয়।

রাজনৈতিক নেতৃত্বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী। বলা বাহুল্য, এই নেতৃত্বও বিত্তবানদের দ্বারা গঠিত। তারাই বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে ও পোশাকে রাজনীতি করে। এদের ভেতর কলহ আছে, সংঘর্ষ প্রায়ই বাধে, যেমনটা ঘটে থাকে পারিবারিক সম্পত্তির দখল নিয়ে ভাইদের মধ্যে। রাজনীতি এখন লুণ্ঠনের লোভে মত্ত বিত্তবানদের অন্তর্কলহ ভিন্ন অন্য কিছু নয়। নেতৃত্ব মোটেই সমাজসচেতন নয়, তবে পুরোপুরি আত্মসচেতন, মুনাফালোভী, ভোগলিপ্সু ও আত্মমর্যাদাহীন বটে। এরা যে সরকারে আসা-যাওয়া করে, সেটা অন্য কোনো যোগ্যতার কারণে নয়; নিছক বিত্ত ও ক্ষমতার বলে। এ পরিস্থিতিতে আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যাদের ভেতর রয়েছে দেশপ্রেম ও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, তারা কী করতে পারি? স্বভাবতই প্রথম কাজ শত্রু কে– সেটা নিরূপণ করা। শত্রু হচ্ছে সেই আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, যা বিত্তবানদের নির্মম ও অরাজক শাসনকে স্থায়ী করে রেখেছে। সংগত কারণেই শত্রু তারাও, এ ব্যবস্থার যারা রক্ষক ও বিশেষ সুবিধাভোগী।

দ্বিতীয় করণীয়, এই বৈরী ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য সংঘবদ্ধ আন্দোলন। আন্দোলন যে নেই, তা নয়। আছে। প্রয়োজন তাকে বেগবান, গভীর ও ব্যাপক করা। সরকার বদলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না, হচ্ছে না। সমাজে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে, যে পরিবর্তনটা আসেনি। আমাদের সমাজ পুরোনো ও জীর্ণ, কিন্তু সে আগের মতোই নিপীড়নকারী ও বৈষম্যমূলক। রাষ্ট্র এ সমাজকে পাহারা দেয় এবং সাধারণ মানুষকে নিপীড়ন করে।

রাষ্ট্র বদলেছে, আবার বদলায়ওনি। কেননা, রাষ্ট্র সেই আগের মতোই নির্যাতন করে। মানুষের অভ্যুত্থান ঘটেছে, যুদ্ধ হয়েছে মুক্তির লক্ষ্যে; কিন্তু সমাজ রয়ে গেছে ঔপনিবেশিক আমলে যে রূপ নিয়ে গড়ে উঠেছিল, সেই রকমই। সাম্রাজ্যবাদ আগেও ছিল, এখনও আছে এবং আমাদের রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদের হুকুমবরদার ও তল্পিবাহক বটে।

সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনকে অবশ্যই রাজনৈতিক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রশ্ন বেশ জরুরি। এক. আন্দোলন কি বড় দুই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে এগোতে পারবে? মোটেই না। কেননা, উভয় দলই হচ্ছে বিত্তবানদের সংগঠন। বিত্তবানরা সমাজের জন্য কেবল যে বোঝা, তাই নয়; তারা দেশবাসীর শত্রুও বটে। আন্দোলন তো আসলে এদের বিরুদ্ধেই; সেখানে তাই মৈত্রীর প্রশ্ন অবান্তর। আন্দোলন পাশাপাশি চলতে পারে, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। দুই. রাষ্ট্রীয় সাধারণ নির্বাচনে সমাজ পরিবর্তনবাদী মানুষের ভূমিকা কী হবে। তারা ভোট দেবে, দুটি খারাপের মধ্যে যেটিকে কম খারাপ মনে করে তাকে সমর্থন করবে; কিন্তু নিজেরা নির্বাচনে প্রার্থী হবে কি? না, আপাতত নয়। অভিজ্ঞতা বলে, নির্বাচন তখনই তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে যখন পেছনে তার আন্দোলন ছিল– যেমন ১৯৪৬, ১৯৫৪ ও ১৯৭০-এ। কিন্তু এমনকি সেই সব তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচনে জয়লাভ করেও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে যে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনা গেছে, তা নয়। তার কারণ নির্বাচনী বিজয়কেই চূড়ান্ত মনে করা হয়েছে এবং তার ডামাডোলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এখন তো দেশে বেগবান কোনো আন্দোলন নেই। সমাজ পরিবর্তনকামীদের পক্ষে এখন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া করুণ ও হাস্যকর ফল নিয়ে আসবে, যেমনটা বিগত একাধিক নির্বাচনে ঘটেছে। তিন. তথাকথিত সুশীল বা নাগরিক সমাজের ভূমিকা কতটা কার্যকর হবে? স্পষ্ট করেই বলা যায়, মোটেই কার্যকর হবে না। সুশীল সমাজ হচ্ছে ভদ্রলোকদের সমাবেশ এবং পুঁজিবাদী বিশ্ব কর্তৃক উচ্চমূল্যায়িত তথাকথিত আন্তর্জাতিক সমাজের মতোই তা ভুয়া। এরা বিত্তবান শ্রেণিরই অংশ এবং বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে সংস্কারের মধ্য দিয়ে টিকিয়ে রাখাটাই এদের অভিপ্রায়। সংস্কার মূল্যহীন নয়। কিন্তু সংস্কার আর সমাজের মৌলিক পরিবর্তন তো এক জিনিস হতে পারে না। সুশীল সমাজ মৌলিক পরিবর্তন চায় না, চাইতে পারেও না। কেননা, ওই ঘটনা ঘটলে তাদের প্রতিষ্ঠিত স্বার্থ বিপন্ন হবে। তদুপরি দেশের ভদ্রলোক সমাজের কর্তাব্যক্তিরা যেভাবে শাসক শ্রেণির দুই দলের সঙ্গে যুক্ত, তাতে বিলক্ষণ বোঝা যায় যে তাদের তৎপরতা কোন লক্ষ্যে নিয়োজিত।

আন্দোলনটি হবে সমগ্র জনগণের। তার অগ্রবাহিনী হিসেবে কাজ করবেন সচেতন মানুষ; যারা দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক; যারা বিশ্বাস করেন, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করতে হবে; যে গণতান্ত্রিকতার প্রধান শর্ত হচ্ছে নাগরিকদের ভেতর অধিকার ও সুযোগের বৈষম্য দূর করা। এদের একাংশ নিজেরা বিত্তবান শ্রেণির মানুষ হতে পারেন, তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু এদেরকে অবশ্যই যেতে হবে শ্রেণিস্বার্থের সংকীর্ণ ও নোংরা সীমানা পার হয়ে সমষ্টিগত স্বার্থের এলাকায়। স্থির থাকবে লক্ষ্য; প্রচার করতে হবে বক্তব্য; সচেতন করতে হবে মানুষকে এবং সংগঠিত হতে হবে অঙ্গীকার নিয়ে। কাজ চলবে স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে; প্রতিটি পেশাতে, প্রতিষ্ঠানে; এমনকি পরিবারের ভেতরেও। কাজটি হবে একই সঙ্গে অন্যায় প্রতিরোধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার। এসব যে আমরা করব, তা কোনো আধ্যাত্মিক সুখ বা নান্দনিক তৃপ্তি লাভের আশায় নয়; নিছক বাঁচার প্রয়োজনে।

অবস্থা এমন যে মনে হয়, আমাদের কোনো আশা নেই। কেননা, যা চোখে পড়ে তা হলো সমাজে আজ সবাই সবার শত্রু। পারস্পরিক মৈত্রীর সব সম্ভাবনাই বুঝি-বা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। প্রকৃত সত্য কিন্তু ভিন্ন রকমের। সমাজের অধিকাংশ মানুষই দেশপ্রেমিক এবং সেখানে গণতান্ত্রিক চেতনার যে মহাদুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে, তাও নয়। অতীতে তারা গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে; ভবিষ্যতে যে ঘটাতে পারবে না– তা মনে করার কারণ নেই। কিন্তু এই মানুষেরা বিচ্ছিন্ন ও বিপন্ন। তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছেন না; তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেওয়া হচ্ছে না এবং তাদের ভেতরকার ঐক্যের অভাবই শত্রুপক্ষের প্রধান ভরসা।

সাহিত্যে যেমন জীবনেও তেমনি, মন্দই চোখে পড়ে সহজে, সে-ই দৌরাত্ম্য করে, কিন্তু সব মন্দই নৈতিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল; নির্লজ্জ ও নৃশংস বলে তাকে পরাস্ত করা কঠিন অবশ্যই, কিন্তু মোটেই অসম্ভব নয়। মানুষের সংস্কৃতির যে অগ্রগতি, তা ওই মন্দকে পরাভূত করেই ঘটেছে; আমাদের দেশেও তেমনটাই ঘটবে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।

ঢাকানিউজ২৪.কম /

আরো পড়ুন

banner image
banner image