সুমন দত্ত
বাংলাদেশে প্রতি বছরই বাজেট হয়। জাতীয় দৈনিকগুলোতে সেই খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়। কোন পণ্যের দাম বাড়ছে, কমছে কোন গুলোর, তার একটির ছোট তালিকা দেওয়া হয়। বাস্তবে পণ্যে মূল্যের এই হ্রাসবৃদ্ধি ছিটাফোঁটাও দেখা যায় না বাজারে। অথচ এ নিয়ে চলে ব্যাপক প্রচার। প্রতিবছর বাজেট আসলেই এসব অসাড় লেখা পড়তে হয় পাঠকদের, আর বাজারে গিয়ে বোকা বনতে হয়। বাজেটের কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না সমাজে।
বাজেটে যে বক্তব্য পেশ করা হয় তাতে সিংহভাগ জুড়ে থাকে সরকারি প্রশাসনের আয় ব্যয়ের হিসাব। যার সঙ্গে সাধারণ জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। ঘোষণা দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য কতটা টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার হিসাব। এই টাকা কীভাবে যোগার করা হবে তার কোনো বক্তব্য নেই।
ধারণা করা হয় সরকারি বিভিন্ন ব্যাংক ও বিদেশি ঋণ নিয়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। বাজেটে বিভিন্ন সেবায় কত পারসেন্ট কর আরোপ করা হবে তা ঘোষণা দেওয়া হয়।
বর্তমানে দেশে চলছে নিত্য পণ্যের উচ্চ মূল্য। পাশাপাশি মান হারাচ্ছে জাতীয় মুদ্রা টাকা। দেশের অর্থনীতি এখন টিকে আছে বিদেশি কামলাদের পাঠানো রেমিটেন্স ও কিছু রপ্তানি পণ্যর জন্য। এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতি ঠিক রাখতে হলে আমাদের রপ্তানি বাড়াতে হবে। তার জন্য খুঁজতে হবে বাজার। যেসব দেশে আমাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা রয়েছে সেই সব দেশে আমাদের পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি না করলে আমাদের অর্থনীতি মুখ থুবরে পড়বে। আর যতটা সম্ভব আমদানি ব্যয় কমাতে হবে।
ভোগ্য পণ্যের অধিকাংশ আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করি। এই আমদানি ব্যয় মেটাতে আমাদের প্রয়োজন পড়ে বিদেশি মুদ্রা ডলার। আর বাজারে রয়েছে ডলার সংকট। এরই মধ্যে মিডিয়ায় প্রকাশ দেশের কয়েকটি ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে মজুদ করে রেখেছে। যে কারণে বাজারে ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী এদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তার কোনো বক্তব্য এই বাজেটে নেই। অথচ এরা অর্থনীতি ধ্বংসকারী।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে গিয়ে ডলার পান না। মাসের পর মাস বসে থাকতে হয়। এজন্য তাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। সরকার এ সমস্যার সমাধান করবেন কীভাবে? প্রতি বছর বাজেট আসে অথচ এই সমস্যাগুলোর কোনো কথা বাজেট বক্তৃতায় থাকে না।
বহুদিন হলো শেয়ার বাজার আগের অবস্থানে যেতে পারছে না। অনেক নিয়ম করা হলো। সার্কিট ব্রেকার লাগানো হলো। লেনদেনের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হলো। তারপরও শেয়ার বাজার গতিশীল হচ্ছে না। আলতু ফালতু কোম্পানি লাভ দেয়। অথচ নামী দামী কোম্পানি শেয়ারের দাম খুব একটা বাড়ে না। এখানে যে কতিপয় জুয়ারি জড়িত রয়েছে সরকার তাদের ধরছে না। অথচ সরকারের কাছে খবর আছে কেন এমনটা হচ্ছে।
জ্বালানি সেক্টরে বিদেশি বিনিয়োগ আমাদের দরকার। সেদিকে কাজ হচ্ছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। মাটির তলের সম্পদ মাটির তলেই পড়ে আছে। উঠানোর ইচ্ছা নাই। উঠালে প্রতিবেশী দেশ আবদার করে বসবে দাও আমাদের। এজন্য পুরো বাংলাদেশ শাস্তি পাচ্ছে। গ্যাসের অভাবে শহরের ফ্ল্যাট গুলো বিক্রি হচ্ছে না। এছাড়া রয়েছে অ্যাপার্টমেন্ট ক্রেতাদের রেজিস্ট্রেশন ফি। এবার সেটা কমানোর ঘোষণা দেওয়া হলেও বাস্তবে সেটা কমছে না। ঘুষ দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয় সবাইকে।
যারা বাসা বাড়িতে রান্না করেন তাদের কাজ সময় মতো হচ্ছে না। অথচ গ্রাহক মাসে মাসে গ্যাস বিল দিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ছে হু হু করে। অথচ এখন এনার্জি সেভিং প্রযুক্তি ঘরে ঘরে। তারপরও বিদ্যুতের চাহিদা মিটছে না। দেশে কয়লা আছে অথচ সেই কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চালাতে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমাদের বাকীতে কয়লা কিনতে হয়। আমাদের নিজেদের জ্বালানির বিভিন্নমুখী ব্যবহার আমরা করতে পারছি না। শকুনের দৃষ্টি পড়ে আছে এই সেক্টরে।
দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয় বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী থাকে। তারমধ্যে সঞ্চয়পত্র অন্যতম। দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে এই খাতে। অথচ এই সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এতে এখানে বিনিয়োগ করে লাভবান হচ্ছে না কেউ। বেশিরভাগ লোক সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গিয়ে ফেলছে। যে কারণে এখন সঞ্চয়পত্রের দিকে মানুষের নজর কম। এছাড়া সঞ্চয়পত্র কিনতে কড়াকড়ি নিয়ম করায় এখানে কালো টাকার বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে।
ব্যক্তি শ্রেণির আয়ের করমুক্ত সীমা বাড়েনি। অথচ প্রতিবেশী ভারতে এই সীমা বাংলাদেশের চাইতে বেশি। সরকার কেন এই জায়গায় কাজ করতে আগ্রহী নয় সেটা জানা যাচ্ছে না। বাজেট হওয়া উচিত জনবান্ধব ও কল্যাণমুখী। সরকারি চাকুরীজীবী ও আমলারাই দেশের একমাত্র জনগণ না। অথচ সরকার বাজেট প্রণয়ন করছেন এদের কে লক্ষ্য করেই। সরকার মনে করে আমলাদের খুশি রাখতে পারলেই দেশ চলবে ভালো। এ কারণে বাজেটে আমলা কামলাদের সুযোগ সুবিধা থাকে বেশি। আর সাধারণ জনগণের জন্য কিছুই থাকে না।
শিক্ষা ও গবেষণাখাতে বাজেটে তেমন কোনো বরাদ্দ নেই। বাংলাদেশের জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তিত এই জলবায়ুতে কয়েকটি কৃষি পণ্যের ফলন ঠিক মতো হচ্ছে না। এজন্য উন্নতজাতের বীজ দরকার। ধানের বীজ , আখের বীজ, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন তেলবীজের উন্নত জাত আবিষ্কার গবেষণা ছাড়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া উচিত সরকারের। উল্টো দেখা যাচ্ছে সরকার বাজেটে সেখানকার অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিভিন্ন গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে কৃষিপণ্যের উন্নত জাত বের করতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা। যারা পারছেন তারা একক প্রচেষ্টায় সফল হচ্ছেন, যেখানে সরকারের কোনো অনুদান নাই। এমনটা হলে দেশ এগিয়ে যাবে না। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লোক নিয়োগ দিয়ে রেখেছে শুধু বেতন ভাতা ভোগ করার জন্য। সেখানে কোনো গবেষণা হচ্ছে না।
আমরা সরকারের কাছে যেমন বাজেট আশা করি তেমন বাজেট কখনই হয় না। তাই এই বাজেট শুধু আনুষ্ঠানিকতা। এর সঙ্গে জীবনমানের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা আশা করব আগামীতে সরকার একটি জনবান্ধব বাজেট দিবেন।
লেখক: সাংবাদিক
ঢাকানিউজ২৪.কম / এসডি
আপনার মতামত লিখুন: