• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৮ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

মানবপাচার বন্ধে প্রয়োজন জনসচেতনতা


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: বুধবার, ০৫ জুলাই, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ০৪:৩৫ পিএম
মানব পাচার দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশে হয়ে থাকে
মানবপাচার বন্ধে প্রয়োজন জনসচেতনতা

সানজীদা আমীন

সমাজে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধ কর্মগুলোর মধ্যে মানব প্রচার অন্যতম অপরাধ কর্ম।মানব পাচারকে সভ্যতা বিবর্জিত জঘন্যতম অপকর্মও বলা যায়। দাসপ্রথা অনেক আগেই উঠে গেছে কিন্তু উদ্ভাবন হয়েছে দাস প্রথার নব্য সংস্করণ। মানব পাচার মূলত নারী এবং শিশু পাচারকে ইঙ্গিত করে থাকে। মানব পাচার একটি সামাজিক ব্যাধিও বটে। আন্তর্জাতিক কনভেনশন মতে, মানব প্রচার হচ্ছে মানুষের অধিকারের লঙ্ঘন। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, মানব পাচার অর্থ কোনো ব্যক্তিকে ভয় দেখিয়ে, বল প্রয়োগ বা প্রতারণার মাধ্যমে তার আর্থসামাজিক, পরিবেশগত বা অন্য কোনো অসহায়ের সুযোগ নিয়ে এবং টাকা পয়সার বিনিময়ে বা অন্য কোনো সুবিধা লাভের জন্য তাঁর ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে এমন কারো সম্মতি নিয়ে এবং বাংলাদেশের ভিতরে বা বাইরে যৌন শোষণ অথবা অন্য কোনো শোষণ বা নিপীড়নের উদ্দেশ্যে ক্রয় বা বিক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর ,চালান বা আটক করা বা লুকিয়ে রাখা বা আশ্রয় দেয়া । কোনো দেশের আইন মানব পাচারের পক্ষে না বরং একে ঘৃণ্য কার্যক্রম হিসেবে গণ্য করা হয়। মানব পাচার দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশে হয়ে থাকে।  মানব পাচারের তিনটি সাধারণ ধরন রয়েছে: যৌন ব্যবসা, জোরপূর্বক শ্রম এবং গার্হস্থ্য দাসত্য । মানব পাচার থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান অর্থনৈতিক খাতগুলো হলো কৃষি, রেস্তোরাঁ, উৎপাদন, গার্হস্থ্য কাজ, বিনোদন, আতিথেয়তা এবং বাণিজ্যিক যৌন শিল্প।

যৌন পাচার হলো মানব পাচারের সবচেয়ে প্রচলিত রূপ । যৌন পাচার হলো একটি উচ্চ মুনাফা এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা যেখানে মানুষের দেহ বারবার বিক্রি করা হয়।  বাণিজ্যিক যৌন শোষণের মধ্যে রয়েছে পতিতাবৃত্তি, পর্নোগ্রাফি, লাইভ সেক্স শো, স্ট্রিপিং, ব্যক্তিগত যৌন দাসত্ব, এসকর্ট পরিষেবা, মেল অর্ডার ব্রাইড, সামরিক পতিতাবৃত্তি, এবং যৌন পর্যটন ।যৌন পাচার সেসব দেশে করা হয় যেখানে শিশু পর্নোগ্রাফি এবং পতিতাবৃত্তির উচ্চ চাহিদা রয়েছে ।  শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা এগুলোর যেকোনো একটির জন্য ঝুঁকির মধ্যে থাকে সব সময়।অনেক সময় পাচারকারীরা বাবা-মায়ের চরম দারিদ্র্যের সুযোগ নেয়। পিতামাতারা ঋণ পরিশোধ বা পরিবারের আয় বৃদ্ধির জন্য শিশুদের পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে অথবা তারা তাদের সন্তানদের জন্য এটি একটি ভালো জীবন হবে ভেবে প্রতারিত হয়ে থাকে। জোরপূর্বক শ্রম মানব পাচারের আরেকটি ধরন। এখানে প্রতারণা বা জবরদস্তির মাধ্যমে শ্রম বা পরিষেবার জন্য একজন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করা হয় । 

জোরপূর্বক শ্রমের প্রবণ এলাকাগুলির মধ্যে রয়েছে গার্হস্থ্য কাজ, কৃষি, নির্মাণ, উৎপাদন এবং আতিথেয়তা । জোরপূর্বক শ্রম শনাক্ত করা  কঠিন। বেসরকারিঅর্থনীতিতে জোরপূর্বক শ্রম প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অবৈধ মুনাফা তৈরি করে। বিশেষ করে দুর্বল অবৈধ অভিবাসীরা বাধ্যতামূলক শ্রমে দিতে বাধ্য হয়।পাচারকারীরা তাদের টার্গেট করে যারা অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত এবং যারা দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে ।

আমাদের দেশে পশ্চাৎপদ এলাকার কিছু সংখ্যক মানুষ মনে করে একবার বিদেশে পাড়ি জমাতে পারলেই ভাগ্য বদলে যাবে। মানুষের এ ধরনের ভাবনা থেকে প্রতারণার শিকার হয়। অধিক জনসংখ্যা, অসচেতনতা, দারিদ্র্য,শিক্ষার অভাব, দ্রুত নগরায়ণ, মাদক ও যৌন ব্যবসা ,প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি বাংলাদেশকে এশিয়ার অন্যতম শিশু ও নারী পাচারের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করেছে। আবার সুখী ও উন্নত জীবনের প্রলোভনে পড়ে আশ্রয়হীন, অসহায় ও হতাশাগ্রস্ত শহরমুখী নারী ও শিশুরাও পাচারের কবলে পড়ে। একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী চক্র নারী ও শিশুদের চাকরি ,বিবাহ, ভালোবাসা বা অন্য কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে তাদের বিদেশে প্রচার করে চলেছে। বছরের পর বছর এসব পাচারকৃত নারী ও শিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতন সহ্য করছে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে।  
 
মানুষকে প্রতারিত হতে দেখেও নিকটতম প্রতিবেশীরা একই দালাল চক্রকে বিশ্বাস করে নিজের বাড়িঘর বিক্রি করে সমস্ত টাকা তুলে দেয় তাদের হাতে।বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মানব পাচার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মানব পাচারের প্রভাব শুধু ব্যক্তির ওপর নয়- সমাজ ,অর্থনীতি ,সংস্কৃতির ওপরও পড়ে। বাংলাদেশে বর্তমানে বঙ্গোপসাগর মানবপাচারের সবচেয়েবড়ো রুটে পরিণত হয়েছে । লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুদের পাচার করা হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মানব পাচার অব্যাহত রয়েছে। বছরের পর বছর এসব পাচারকৃত নারী ও শিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতন সহ্য করছে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাকরি দেওয়ার নাম করে লোকজনকে পাচার করা হচ্ছে। নারীরা পাচারের মাধ্যমে ধর্ষিত হচ্ছে। শিশুদের বিদেশে পাচার করে তাদের দিয়ে উটের জকি,ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতায়সহ  বিভিন্ন কষ্টকর কাজ করানো হচ্ছে। শিশুদেরপাচার করে অঙ্গপ্রতঙ্গ বিক্রি করে দিচ্ছে। পাচারের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার অসৎ লোকজন জড়িত রয়েছে। দিনদিন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে মানব পাচার চক্র। কক্সবাজার ও টেকনাফ কেন্দ্রিক মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত চক্র সক্রিয় অনেকদিন ধরে। তারা হত্যাকাণ্ডেরও জন্ম দিচ্ছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে গভীর রাতে পাচারের কাজটি করা হয়।আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে  পাচারের একাধিক চক্র সক্রিয় রয়েছে কক্সবাজার জেলায়। উখিয়ার সোনারপাড়াসহ আশপাশের এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক এবং টেকনাফে অর্ধশত পাচারকারী এ কাজে জড়িত রয়েছে । মানব পাচার চক্রের সদস্যরা জাহাজ জোগাড় করে যাত্রীদের দেশের বাইরে পাঠাচ্ছে। তাদের জাহাজে কাটাতে হয় মাসের পর মাস। মাঝেমধ্যে শুকনো খাবার দিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখা হয়। কারো মৃত্যু হলে ফেলে দেওয়া হয় মাঝ সমুদ্রে। বিমানবন্দরগুলোতে কড়াকড়ি আরোপের ফলে পাচারকারীরা সাগর পথে মানব পাচারকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে করে।

একসময় পরিচিতদের মাধ্যমে বা সরাসরি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে, ফুঁসলিয়ে বা লোভ দেখিয়ে  মানব পাচার করা হলেও এখন সেখানে বড়ো উপাদান হয়ে উঠেছে প্রযুক্তি। এখন পাচারকারীরা মানব পাচারের কাজে প্রযুক্তির ব্যবহার করে থাকে।শিকার ফাঁদে ফেলতে এখন নানাভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম।অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে মানব পাচারকারীদের মানরপাচারে জন্য  শিকার ধরতে  এবং তাদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়েসহ  পাচারকারীদের নিজেদের মধ্যেও যোগাযোগ অনেকসহজ হয়ে উঠেছে।খুব সহজেই মানব পাচারকারীরা আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে এ জঘন্য  কাজটি করার চেষ্ঠা করে চলছে।আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীও এখন অনেক দক্ষ এবং প্রযুক্তি নির্ভর। মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ।এতে অনেক পাচারকারীকে আটক করে আইনের হাতে সোপর্ধ করা সম্ভব হয়েছে ।অনেক ভিকটিমকে উদ্ধার করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।তারপরও এগেুলো বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না শুধু সচেতনতার অভাবে।
 
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে অবৈধ মানব পাচারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছে। মানব পাচার প্রতিরোধে প্রতি জেলা ,উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কাউন্টার ট্রাফিকিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। কোনো নাগরিক যাতে অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার নামে আত্মহননের পথ বেছে না নেয় এ জন্য সমাজকে সচেতন হতে হবে। সীমান্ত বা জল-স্থল ও আকাশ পথে নজরদারি বাড়াতে হবে।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মানব পাচার মোকাবিলায় সরকারের প্রধান সংস্থা যাদের প্রচারের শিকার ভিকটিমকে শসনাক্তকরণের জন্য আদর্শ পরিচালনা পদ্ধতি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর বা এসওপি) রয়েছে। সংশ্লিষ্ট আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং অপরাধীকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করছে।মানব পাচার আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।'মানব পাচার' আইনের ৬ ধারা অনুসারে মানব পাচার নিষিদ্ধ করে এর জন্য অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
 
তবে যতই সচেতনতামূলক প্রচারণা হোক না কেন, জীবিকার মানোন্নয়ন ছাড়া মানব পাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ লক্ষ্যে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।সরকার যুব সমাজকে কর্মমুখী করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণের পাশাপাশি উদ্যোগতা তৈরির কাজ করছে।গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ।২০৪১ এ উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে দেশ।ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সোনার বাংলাদেশ গড়তে পারলে এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে মানব পাচার।   

ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন

আরো পড়ুন

banner image
banner image