• ঢাকা
  • শনিবার, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৭ জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

কুমিল্লায় মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সংগ্রহশালা স্থাপনের বিকল্প নেই  


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: রবিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১২:৫০ পিএম
কুমিল্লায় মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য ধরে রাখতে সংগ্রহশালা স্থাপনের বিকল্প নেই  
হানাদার মুক্ত দিবস

মশিউর রহমান সেলিম, কুমিল্লা : কুমিল্লা দক্ষিনাঞ্চলে বৃহত্তর লাকসাম হানাদার মুক্ত দিবস আগামীকাল ১১ ডিসেম্বর। বাঙালী জাতির গৌরবোজ্জল মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মাসের শুরু। ১৯৭১ সালের এ ডিসেম্বর বাঙালী জাতির জীবনে নিয়ে এসেছিল এক মহান অর্জনের আনন্দ। ৭১’র  এ মাসেই পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত হয় এ অঞ্চল। পাক লোকজনের সু-দীর্ঘ ২৩ বছরের শোষন-বঞ্চনা আর অত্যাচার-নির্যাতনের কবর হয় বিজয়ের এ মাসেই। পাকবাহিনীর কবল থেকে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধারা এ দিনে লাকসাম হাইস্কুল মাঠে তৎকালীন ছাত্রনেতা মরহুম নজির আহমেদ ভুঁইয়া প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করেন। দিবসটি পালন উপলক্ষে জেলা দক্ষিনাঞ্চলের ৫টি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সরকারী- বেসরকারী সংগঠন দিনব্যাপী নানাহ কর্মসূচী হাতে নিয়েছে।

আগামী দিনে তরুন প্রজন্ম যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিক ভাবে অবহিত হতে পারে এবং স্বাধীনতা বিরোধী চক্র কোনদিন ইতিহাস বিকৃতি করতে না পারে সে জন্য প্রতিটি জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রহশালা স্থাপনের কোন বিকল্প নেই। তাহলেই শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা-শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার-আলবদরদের চূড়ান্ত তালিকা সংরক্ষন করা সম্ভব বলে দাবী স্থানীয় একাধিক মুিক্তযোদ্ধাদের। 

এ অঞ্চলের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা শহরে পাক হানাদার বাহিনী বাঙ্গালী নিধন শুরু করলে সেই দিন থেকে বৃহত্তর লাকসামের মুক্তি পাগল সকল পেশার মানুষ পাক সেনাদের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের বিভিন্নস্থানে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সু-সংগঠিত করা এবং সুষ্ঠভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বৃহত্তর লাকসামকে ৪টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। ৪টি সেক্টরের যুদ্ধকালীন কমান্ডার হিসাবে মো. আবু তাহের মজুমদার, মো. ছায়েদুল ইসলাম, আবুল বাশার ও মো. আবদুল মালেক দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি এ অঞ্চলের চারিদিকের সীমানা নিয়ে গঠিত ৪টি সেক্টর কমান্ডের সাথে একাধিক প্লাটুন মানুষ গেরিলা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। লাকসামের উত্তরে বিজয়পুর (বর্তমান সদর দক্ষিণ ও নবগঠিত লালমাই উপজেলা), পশ্চিমে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলা, দক্ষিণে নোয়াখালী জেলার বর্তমানে সোনামুড়ি উপজেলা এবং পূর্বে বর্তমান চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ভারত সীমান্ত ছিল এ অঞ্চলের যুদ্ধকালীন এলাকা।

যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন বিগ্রেডে ৪’শ ৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকলেও স্বাধীনতার ৫২ বছরে শুধু দীর্ঘ হচ্ছে স্বঘোষিত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। এ নিয়ে জেলার ৫টি উপজেলার জনমনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নেতৃবৃন্দের রহস্যজনক নীরবতায় হরেক রকম কানাঘুষা হচ্ছে। ১৯৭১ সালের এ মাসেই শুরু হয় পাক সেনাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করলেই পাল্টা প্রতিরোধে ঝাপিয়ে পড়ে এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয় আম-জনতা। দীর্ঘ ৯ মাস যূদ্ধ শেষে কয়েক হাজার মানুষের রক্ত এবং কয়েক’শ নারীর ইজ্জতের বিনিময়ে এ মাসেই পান বিজয়ের স্বাদ।  

অপর একটি সূত্র জানায়, লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণে থ্রী-এ সিগারেট ফ্যাক্টরী ও পশ্চিমগাঁও শহীদ মিয়ার বাড়ী এ অঞ্চলের পাকহানাদার বাহিনীর মূল ঘাঁটি ছিল। এ অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা, অস্ত্র এবং যুদ্ধের যাবতীয় উপকরণ সরবরাহ করা হতো এখান থেকেই। এ ঘাঁটিতে বিভিন্ন স্থান হতে বাঙ্গালী নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতীতের ধরে পাশবিক নির্যাতন শেষে হত্যা করে রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণ পাশেই রেল-লাইনের পূর্ব দিকে বেলতলী নামক স্থানে গণকবর করে মৃত লোকজনকে মাটি চাপা দেয়া হতো। বর্তমানে এ স্থানটি লাকসাম বেলতলী বধ্যভূমি নামে পরিচিত। বৃহত্তর লাকসামে মুক্তিসেনাদের সাথে সকল পেশার মানুষ অংশ নিয়ে প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখে ৮ ডিসেম্বর থেকে পাক-সেনারা পিছনে হটতে থাকে অবশেষে ১১ ডিসেম্বর আজকের এ দিনে বৃহত্তর লাকসাম অঞ্চলটি পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। 

যুদ্ধকালীন বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বৃহত্তর লাকসামে ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর হায়দার ও খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এ অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে স্বশস্ত্র শুদ্ধ শুরু হয়। পাশাপাশি সাব-কমান্ডিং অফিসার মাহবুবের পরিচালনায় এফ এফ ব্রিগেডের কমান্ডার আসাদুজ্জামান মিরন, মরহুম আবদুছ সাত্তার মজুমদার, কমান্ডার আবুল বাশার, মরহুম আবদুল কুদ্দুস, আবু তাহের মজুমদার, মনিরুল আনোয়ার, শামসুল হক, এড.নির্মল দাস, আবুল হোসেন ননী ও পিস্তল বাশারসহ ৩’শ১৩ জন। বিএলএফ বিগ্রেডের কমান্ডিং অফিসার ছায়েদুল ইসলামের নেতৃত্বে বৃহত্তর লাকসাম, বরুড়া ও চৌদ্দগ্রাম থানা নিয়ে  অঞ্চল ভিত্তিক বিগ্রেড গঠনের মাধ্যমে আবদুল বারী মজুমদার, এটিএম আলমগীর, সৈয়দ লুৎফর রহমান. মরহুম নজির আহমদ ভূঁইয়া, আবদুল খালেক দয়াল, মরহুম মোস্তফা কামাল খান, জাহাঙ্গীর মাওলা চৌধুরী ও আবু তাহের মজুমদারসহ ৩৪ জন এবং আরএফ নামে যৌথবাহিনী হিসাবে আর্মি, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদসহ অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারীদের নিয়ে ১’শ২৫ জন ছাড়াও স্থানীয় ভাবে ছাত্র জনতার সাথে ভারতীয় মিত্রবাহিনী এ যুদ্ধে অংশ নেয়। 

যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সূত্র জানায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চালাকালে সাংগঠনিক ভাবে বিশেষ অবদান রেখেছেন স্থানীয় ব্যাক্তিত্ব মরহুম জালাল আহমেদ, মরহুম আবদুল আউয়াল, মরহুম ভাষা সৈনিক কমরেড জিন্নতের রহমান, মরহুম খোরশেদ আলম সুরুজ, হোসেন টিটি, মরহুম আলতাফ আলী, মধু মিয়া, মরহুম মানু মিয়া চৌধুরী ও মরহুম হাবিবুর রহমানসহ নাম জানা- অজানা অনেক ব্যাক্তিত্ব। অথচ ওইসব মহান ব্যাক্তিদের এখন আর কেউ স্মরন করে না। আবার এ অঞ্চলে পাকহানাদার বাহিনীর পক্ষে শান্তিবাহিনীর প্রধান হিসাবে নেতৃত্ব দেন সহিদ উল্যাহ (পশ্চিমগাঁও), রফিকুল হোসেন নরপাটি, নূর আহমদ (নরপাটি), মাওলানা অদুদ ভূঁইয়া (শানিচোঁ), নুরুল হক (কান্দিরপাড়) ও মোখলেছুর রহমান (দূর্গাপুর)সহ নাম না জানা প্রায় অর্ধশতাধিক লোক স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতা করেন। পশ্চিমগাঁও সহিদ উল্যাহর বাড়ী  ও নশরতপুরস্থ থ্রী এ সিগারেট ফ্যাক্টরীতে তাদের প্রধান আস্তানা হিসাবে ব্যবহার করছিল। 

জেলার দক্ষিনাঞ্চলের ৫টি উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের স্মৃতিচারন করে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সূত্র জানায়, দেশব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়েছে, পাকবাহিনী এ অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে এখন আমরা অসহায় বোধ করছি। ছায়েদুল ইসলাম, মোস্তফা কামাল খান, নজির আহমেদ ভূঁইয়া ও মো. ইসহাক মিয়ার সহায়তায় তাৎক্ষনিক পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে লাকসাম জিআরপি থানা থেকে অস্ত্রসস্ত্র সংগ্রহ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। ১৪ এপ্রিল লাকসামের পেরুল এলাকায় পাক বাহিনীদের প্রথম প্রতিরোধ করা হয়। পরে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধা সকল ইউনিট ও সংগঠন সদস্যদের প্রচন্ড বন্দুক যুদ্ধ। সপ্তাহের মধ্যই এ অঞ্চলের বড়বাম, আজগরা, ফতেপুর, পশ্চিমগাঁও, কাদ্রা, গাজীমুড়া, উত্তরকুল, ধামৈচা, গৈয়ারভাঙ্গা, পারবাইন, বেলঘর, নরপাটি, কান্দিরপাড়, খিলা ও শহরের বেশ কটি গ্রামে পাকবাহিনীর সাথে সন্মুখ যুদ্ধে শত শত লোক নিহত হয়। এতে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছে। শান্তিবাহিনীর মূল ঘাঁটি  ওইসব স্থান থেকে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সকল যুদ্ধ সরঞ্জাম সরবরাহ করা হতো এবং এ ঘাটি দুটো ছিল তাদের টর্চার সেল। 

যুদ্ধকালীন সময়ের এক বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা দুঃখ করে বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীণ সময়ে এ অঞ্চলে এফএফ ৩’শ১৩ জন, বিএলএফ ৩৪ জন ও আরএফ ১’শ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হলেও স্বাধীনতার ৫২ বছরে বিভিন্ন দলীয় সরকারের বিবেচনায় কুমিল্লা দক্ষিনাঞ্চলের ৫টি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা শুধু দীর্ঘই হচ্ছে। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যার তালিকায় প্রায় সহস্রাধিক লোকের নামের তালিকা নিয়ে  এ অঞ্চলের জনমনে নানাহ কানাঘুষা হচ্ছে। সূত্রটি আরো জানায় লাকসামে ৬৪, মনোহরগঞ্জে ৫৯, নাঙ্গলকোটে ৯৪, সদর দক্ষিনে ৫৩ ও বরুড়ায় ৩৯ জন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম নিয়ে যথেষ্ট তোলপাড় শুরু হয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে বর্তমান সরকারের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই নিয়ে বিভিন্ন উপজেলায় পকেট বানিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, ভাতা পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার-আলবদরদের চূড়ান্ত তালিকা তৈরী নিয়ে রয়েছে হাজারো বির্তক।  বর্তমানে নানাহ কারণে সরকার মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রম স্থগিত করেছেন। 
 

ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন

আরো পড়ুন

banner image
banner image