• ঢাকা
  • শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

জন্মদিন: বহুমাত্রিক সেলিনা হোসেন


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ০৫:০৬ পিএম
নারীকে একজন মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন
সেলিনা হোসেন

নাসরীন জেবিন

সেলিনা হোসেন তাঁর সৃষ্টির সাম্রাজ্যে বাঙালির হাজার বছরের মিথলজিক্যাল ইতিহাসকে ধারণ করে তাঁকে গৌরাবান্বিত করেছেন। তিনি নারীর আত্মিক অধিকারের বিষয়ে আজন্ম প্রতিবাদী ছিলেন কিন্তু তিনি নারীবাদী ছিলেন না। নারীকে তিনি আলাদা করে নারী হিসেবে বিচার করতে চাননি– তাঁর সৃজনে নারীকে একজন মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
 

সেলিনা হোসেন সহজাত লেখনী সত্তায় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চরিত্রে অবগাহন করেছেন। কাহিনির গভীরতা থেকে উপন্যাসের নানা চরিত্রের নির্মাণ আমাদের যেমনি মুগ্ধ করেছে, তেমনি সময়, সমকাল ও সমাজ নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সেলিনা হোসেনের সৃজনের উঠোন জুড়ে প্রতিনিধিত্ব করেছে সমাজের মানুষ। বাঙালির সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস গভীর মমতায় মানুষের নানা চরিত্রের মাঝে বপন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের একাত্তর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।’ তাই তাঁর সৃষ্টিতে বারবার ’৭১-এর কাছে তাঁকে ফিরে যেতে দেখেছি। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘যুদ্ধ’, ‘গেরিলা ও বীরাঙ্গনায়’ মানুষের নানামুখী মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তিনি আলাদা মাত্রা যোগ করেছেন। তাঁর সৃষ্টিতে প্রেম, দ্রোহ, জীবনাচরণ, সামাজিক বৈষম্য, বঙ্গবন্ধু, নারীমুক্তি, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়কে উপাত্ত করে মানুষের আত্মপ্রত্যয়ী মরণপণ লড়াইকে তিনি অভিনন্দিত করেছেন। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ (১৯৭৬) উপন্যাসে স্বাধীনতা ও মুক্তির সমুজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। যে ইতিহাসকে যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ে বুকে ধারণ করেছে হলদি গ্রামের বুড়ি। যুদ্ধ শুধু একটি গ্রামকেই গ্রাস করে না– জনজীবনের প্রতিটি মানুষকে তার অংশ করে নেয়।

বুড়ি সমাজ সংসারের নিয়ম ভেঙে দুঃখের জীবনে হাসির ফোয়ারা ফুটিয়ে দেয়। সলীম-কলিমের মায়ের ভূমিকায় মানিয়ে নিলেও নিজ সন্তানের জন্য তাঁর হৃদয় কাঁদত। স্বামী গফুর কিশোরী বুড়ির রোমান্টিক মানসিকতায় উদ্দীপনা জুগিয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বুড়ির চেতনা জগৎ পরিবর্তন করে দেয়। কিশোরী বুড়ির বেড়ে ওঠার পাশাপাশি স্বপ্নচারিত জীবন নানামুখী চেতনায় ঘূর্ণায়িত হয়েছে। চরিত্রের বহুমুখী গতিবৈচিত্র্য এক মহাসৌন্দর্য নৃত্যের আভাস দিয়েছেন লেখক। বুড়ির মুক্তমনের চেতনা মানবিক অধিকারবোধ বিশ্বজনীন মুক্তির বাণী শুনিয়ে যায়। বুড়ি তখন আপন আলোয় নারীর অসামান্য হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতের বাস্তবতা থেকে সরে মানুষের সর্বজনীন অধিকারবোধে উচ্চকিত হয়ে ওঠে এভাবেই–
‘...মাঝে মাঝে মনে হয় ওরা আমার কেউ না। এবার আমার নিজের চাই। নাড়ি ছেঁড়া ধন চাই। আমার শরীরের ভেতর উত্থাল-পাতাল চাই। আমার! আমার।’ [হাঙর নদী গ্রেনেড]

 

সেলিনা হোসেন আত্মপ্রত্যয়ী একজন যোদ্ধা। নিজের লড়াকু জীবনে যেমনি তিনি জয়ী হয়েছেন, সৃষ্টির সাম্রাজ্যেও তিনি জয়ী। ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসে তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্তরকে ধারক করেছেন। এই উপন্যাসে আলাদা কোনো কাহিনি নেই কিন্তু প্রতিটি মানুষ চেতনায় মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছে। তারামনকে অত্যাচারী প্রতিবন্ধী স্বামী তালাক দিলে তার মুক্ত স্বাধীন সত্তা জেগে ওঠে এভাবেই–
‘নিজের বাড়ি ফেরার আনন্দে সে একটি শাড়ি ও দুটি ব্লাউজের ছোট পুঁটলিটা উপড়ে ছোড়ে আর দু’হাতে ধরে।’
– যুদ্ধ মানুষকে প্রকৃত মানুষ করে দেয়, এক ধর্মের মানুষকে অন্য ধর্মের করে দেয়। যুদ্ধে বেনুর গর্ভ হওয়াকে সে অঙ্গহানি বলে চিহ্নিত করে। মুক্তিযোদ্ধা মাখনকে সে বলে–

 

‘যুদ্ধে আমার অঙ্গ যখম হয়েছে। আমি ভালো হয়ে যাবো। আমি তোমারই আছি।...গর্ভ? কিসের গর্ভ? এটা জরায়ুর যখম। তুমি দিয়েছ পা আর আমি দিয়েছি জরায়ু। যুদ্ধ শিশুই হবে আমাদের যুদ্ধের সাক্ষী।’ [হাঙর নদী গ্রেনেড]
–সেলিনা হোসেন মানবিক চেতনাসমৃদ্ধ জীবন প্রবাহের শৈল্পিক বুননে তাঁর উপন্যাস সমূহের সমস্যা আর সংকট থেকে মানুষকে উত্তরণের জন্য সাহস জুগিয়েছেন।

 

‘জলোচ্ছ্বস’ উপন্যাসে বাঙালি জীবনের ঐতিহ্যিক পটভূমির ওপর রচিত। ছুটে চলা জলোচ্ছ্বাস মানুষের জীবনস্বপ্ন মুছে দেয়। চিরকালীন শান্ত প্রকৃতি হয়ে ওঠে বিষণ্ন ও আতঙ্কিত এক জনপদ। বঙ্গোপসাগরের হৃদয়হীন তাণ্ডব মানুষের সোনার সংসার নিঃশেষ করে দেয়। চির দুঃখের সংসার চোখে জলে নদী হয়ে যায়। ‘জলোচ্ছ্বাস’ উপন্যাস যেন স্বপ্নচারী মানুষগুলোই সৃষ্টির শরীরকে নতুন পথের সন্ধান দেয়। আকস্মিক জলোচ্ছ্বাস নিম্নবৃত্তের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে যেন জীবনের অনিবার্য বিয়োগপত্র ফেলে আবার বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্নকে তারা আলীঙ্গন করেছেন এভাবেই–
‘জীবন আর মৃত্যু এখানে একই মিছিলের সাথী। বেঁচে থাকার কঠোর সংগ্রাম ওলোট-পালোট হয়ে গিয়ে রূপ নেয় মরণ বিজয়ী সংগ্রামে। জীবনকে ছিনিয়ে আনতে হয় সাগরের থাবা থেকে।’ [জলোচ্ছ্বাস]

 

–১৯৪৭-এর পর আমাদের অধিকার আদায়ের জায়গায় গণমানুষের দাবি সোচ্চার হয়েছিল। ১৯৪৭-এর পর সেলিনা হোসেন আমাদের জাতীয় সংকটগুলোকে উপাত্ত করে জনমানুষের দাবির চেতনায় তাকে অংশীভূত করে সৃষ্টি করেছেন একের পর এক উপন্যাস।
 

‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’ (১৯৮৭) উপন্যাসে সেলিনা হোসেন ইতিহাসকে অক্ষুণ্ন রেখেই কাহিনি বিনির্মাণ করেছেন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলি আমাদের অস্তিত্ব নির্ধারণের পর্যায়কাল হিসেবে চিহ্নিত। এই সময়ের আলোকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র ইতিহাসের উপকরণ থেকে সংগৃহীত। সময়ের দাবি সময়েই পূরণ করতে হয়। তা না হলে সংকট মোকাবিলা করতে হয়। সে সময় যে সমগ্র চরিত্র সংকট মোকাবিলা করতে এগিয়ে এসেছেন তাঁদের উপন্যাসের চরিত্রের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে লেখক পরিচয় করিয়েছেন। সোমেন চন্দ্র, রমেশ দাশ গুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নির্মল সেন, অচ্যুত গোস্বামী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু, মুনীর চৌধুরী, সতীশ পাকড়াশির মতো ব্যক্তিত্বরা। অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনেই এসব মানুষ অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাজনৈতিকভাবে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, প্রগতি লেখক সংঘ এবং তৎকালীন বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এসব গুণী মানুষগুলোই গণমুখী সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন। মূল লক্ষ ছিল– অধিকারহীন মানুষগুলোকে শক্তি-সাহস জুগিয়ে অধিকার আদায়ের জন্য প্রস্তুত করা।
 

তিরিশের দশকে কমিউনিস্ট হয়ে ওঠার জন্য অনেক বিপ্লবী নেতা জীবন দিতে তখন প্রস্তুত ছিল। কারণ তখন পৃথিবীব্যাপী সাম্যবাদী আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছে। সোমেন চন্দ্রকে আমরা দেখেছি, বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা সতীশ পাকড়াশির কাছে যাচ্ছেন বুদ্ধি নিতে। প্রগতিশীল সাহিত্যিকরাও সোচ্চার হয়েছিলেন সাম্যবাদী চেতনায় পৃথিবীকে এগিয়ে নিতে। সেলিনা হোসেন তাঁদের এই চেতনামিশ্রিত অনুভূতিকে সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন। মুনীর চৌধুরী তাঁর মেধা-মনন ও প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী হওয়ার সুবাদে আদর্শায়িত রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে প্রথম থেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় সোমেন চন্দ্র মারা যাবার পর উদ্দীপ্ত প্রাণোচ্ছ্বলবাগী কর্মী মুনীর চৌধুরীর ওপর দায়িত্ব এসে পড়ে। মুনীর চৌধুরী বিলাসী জীবনযাপন করতেন। এই বিলাসী জীবনকে ড. আনিসুজ্জামান চিহ্নিত করেছেন এভাবেই–
 

‘সেই পাথরের বোতামওয়ালা শেরওয়ানি, পান খাওয়া, পঞ্চাশ সিগারেটের টিন কেনা, কিন্তু তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন তাঁর অপূর্ব বাগ্মিতা, সাহিত্যের রসগ্রাহিতা ও পড়াশোনার ব্যাপকতার জন্য।’ [আনিসুজ্জামান, মুনীর চৌধুরী, ঢাকা জাতীয় সাহিত্য প্রকাশন-১৯৯৬]
–গুণী ও যোগ্য মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র মুনীর চৌধুরী নিজেকে ক্রমে পরিবর্তন করেন। চিন্তা-চেতনায় নিজেকে আমূল পাল্টে ফেলেন। আভিজাত্যের আর কোনো কিছুই নিজের কাছে অবশিষ্ট রাখেননি।

 

ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’ উপন্যাসে ভাষা আন্দোলনে মুনীর চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি টেনেছেন।
‘আগস্টের একরাত’ উপন্যাস ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ডের পটভূমির ওপর রচিত হয়েছে। ওই রাতে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড জাতির জীবনের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সঙ্গে মানুষের আবেগ, উচ্ছ্বাস, আনন্দ, বিষাদ, নিষ্ঠুরতাসহ পরস্পরবিরোধী নানা কার্যকলাপ মনুষ্য চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক আবহে উপস্থাপন করেছেন। বর্ণনাতীত হিংস্রতার সঙ্গে সপরিবারে আত্মীয়-স্বজনসহ সবাইকে হত্যা করা হয়। অনেক কাছের মানুষের অনুরোধেও বঙ্গবন্ধু নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেননি। সেলিনা হোসেন এ মৃত্যুকে অত্যন্ত বেদনার্ত হৃদয়ে ধারণ করেছেন এভাবেই–
‘আপনি বাংলার মানুষকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন। আপনি মনে করতেন বাংলার এমন কোনো মানুষ নেই যে আপনার গায়ে হাত দিতে পারে। এই সুগভীর বিশ্বাস থেকে আপনি অন্যদের কথা বিশ্বাস করেননি। প্রত্যেকের সতর্কবাণী থামিয়ে দিয়েছেন।’ [আগস্টের একরাত]

 

সেলিনা হোসেনের বুদ্ধিদীপ্ত চেতনার আরেক সৃজন ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাস। এ উপন্যাসে লেখক ঐতিহ্যের অনুসন্ধানী দৃষ্টি মেলে ধরেছেন। পূর্ব বাংলার জনপদে যে অন্ত্যজ দুঃখী দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তান শাসক দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে তারই বাস্তব চিত্র এ উপন্যাসে পাই। লেখক অধিকারহারা মানুষের শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাসকে রূপকের অন্তরালে উপস্থাপন করেছেন। ভারতবর্ষে প্রাচীন যুগ থেকে অন্যান্য অবিচারের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে যে পদ্ধতিতে প্রতিবাদ করা হতো– আজও তা সমাজজুড়ে প্রবাহিত আছে। স্বাদেশিকতার শেকড়কে তিনি এ উপন্যাসে অনন্য মর্যাদায় উপস্থাপন করেছেন। ইতিহাস ঐতিহ্যকে অনুসন্ধান করে লেখক এ উপন্যাসের মানুষগুলোকে চর্যাপদাবলির বিভিন্ন উপাদান উপকরণ থেকে সংগ্রহ করেছেন। একমাত্র চর্যাপদই ছিল সে সময়ের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য দলিল।

ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে যে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, সেখান থেকে তিনি কলম ধরেননি– তারও পেছনে দৃষ্টি নিবন্ধ করেছেন। হাজার বছরের পুরোনো বাংলা ভাষায় বৌদ্ধগণ ও দোহা যাকে আমরা চর্যাগীতি বলে আখ্যায়িত করি– সেখানে তিনি পরিভ্রমণ করে সৃষ্টি করেছেন ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাস। চর্যায় কবিরা ধর্ম সংগীত রচনায় মনোনিবেশ করার সময় নিজেদের সামাজিক সুখ-দুঃখ কষ্টের ইতিহাসকে প্রাধান্য দিয়েই গীত রচনা করতেন। কারণ তাঁরা ভূমিহীন কৃষক সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে বসবাস করতেন। অর্থনৈতিক শ্রেণি-বৈষম্যের পাশাপাশি শ্রেণি সংঘর্ষের সে চিত্র আমরা তাঁর কবিতায় পেয়েছি। চর্যায় রাজা, উজির, ব্রাহ্মণদের প্রতি প্রবল ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে। কাহ্নপাদের মতো কুক্কুরীপাদও ছিলেন কবি। আদিকালে রাজদরবারের ভাষা ছিল সংস্কৃত। সাধারণ প্রজারা বাংলা ভাষায় কথা বলত, যা ছিল বিত্তবানদের কাছে অবহেলিত। ভুসুক কাহ্নপাদের বন্ধু। সে কবিতা লেখে, কুক্কুরীপাদও গীত রচনা করে। সে সমাজ সংসারে বন্দি নয়, মুক্ত স্বাধীন, অরণ্যচারী, পর্বতবাসী। তিনি গান বাঁধেন এমনই–
‘রুখে তেন্তুরি কুম্ভিরে খাতন।’

 

–কুক্কুরীর এ গান শুনে কাহ্নপাদ খুশি হয়েছিলেন। কাহ্নপাদ যেহেতু কবি তাই সে রাজদরবারে বাংলা ভাষায় কবিতা পড়তে চেয়েছিল। নিজের ভাষাকে রাজদরবারে মর্যাদা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজ তাদের অস্পৃশ্য মনে করে দূরে রাখত। সাধারণের সঙ্গে মেলামেশাকে পাপ বলে মনে করত। কাহ্নপাদের রাজদরবারে কবিতা পড়ার ইচ্ছার কথা শুনে তাকে অপমান করেছিল। শাসক শ্রেণির কাছে তার অধিকার আদায়ের জন্য সে প্রতিবাদ করেছি। কাহ্নপাদ রাজদরবারের কর্মচারী হওয়ায় সে দেখেছে রাজদরবারে সর্বদা সংস্কৃত ভাষায় সভা-সমাবেশ হয়। কাহ্নপাদ এ ভাষার পাশাপাশি তার শ্রেণির বহু মানুষের মুখের ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। রাজমন্ত্রী তাকে সে সুযোগ দেননি। বরং কাহ্নর ভাষাকে অবজ্ঞা করে ‘ছুঁচোর কেত্তন’ বলে অপমান করেন।
 

মানুষের জীবন জিজ্ঞাসার ইতিহাসের ঐতিহ্যিক শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ তাঁর ‘পোকা মাকড়ের ঘর বসতি’ উপন্যাস। নাফ নদীর তীরে লড়াকু মানুষের জীবনের স্বপ্নতাড়িত জনগোষ্ঠীর জীবনধারা তিনি তুলে ধরেছেন। ‘পোকা মাকড়ের ঘর বসতি’ উপন্যাস দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার সমুদ্র সংলগ্ন জীবনের অস্তিত্ব-সংকট সমন্বিত উপন্যাস। অসীম সাহস, লড়াকু জীবন, স্বপ্নচারী ও প্রেমময় মানুষ প্রবহমান নদীর মতোই ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে জীবন স্বপ্ন বুনে যায়। যে জীবন রামধনু পাখা মেলে উড়ে চলে জীবনের সঙ্গে জীবনযোগে। সে স্বপ্নের মাঝে দাবানলের ঘুড়িওয়ালা দুপুর এসে বিষাদের গান শুনিয়ে যায়– শুনিয়ে যায় নতুন জীবন স্বপ্নের স্বর্ণখচিত ইতিহাস।

ঢাকানিউজ২৪.কম /

আরো পড়ুন

banner image
banner image