পাভেল পার্থ
সাঁওতাল বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। রবীন্দ্রনাথ সরেনের পারিস বা গোত্র ‘সরেন’। সরেন গোত্রকে সাঁওতাল সমাজে একই সঙ্গে ‘যোদ্ধা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রবীন্দ্রনাথ সরেন আরও বলেছিলেন, আমরা ফুলমণি, সিধো, কানহু, বীরসা, শিবরাম মাঝির উত্তরাধিকার। যাদের নাম উল্লেখ করা হলো তারা হুল, উলগুলান কিংবা তেভাগা সংগ্রামের নায়ক। ফুলবাড়ী থেকে ভীমপুর, বাগদাফার্ম থেকে বগুড়া, নাচোল থেকে ভাওয়াল, চা বাগান থেকে মধুপুর, সমতল থেকে পাহাড় সাহস নিয়ে দাবড়ে বেড়ানো রবীন্দ্রনাথ সরেন ১২ জানুয়ারি গভীর রাতে অনন্তলোকে যাত্রা করেন।
বাংলাদেশের সর্বশেষ ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯ এবং জাতিগোষ্ঠী ৫০।
বারকোণা থেকে দশদিগন্ত
উত্তরাঞ্চলের বহু স্থানের নাম সাঁওতালি ভাষায়। বীরটোলা, বিরল, বীরগঞ্জ। সাঁওতালি ভাষায় ‘বীর’ মানে জঙ্গল। দিনাজপুরের পার্বতীপুরের বারকোণা গ্রামটিও ছিল জঙ্গলময়। আশপাশে সব ছিল আদিবাসী বসতি। বারকোণা গ্রামে ১৯৫৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর জন্ম নেন রবীন্দ্রনাথ সরেন। মা সুমি টুডু ও পিতা দারকাল সরেন। চার ভাইবোনের ভেতর রবীন্দ্রনাথ সবার ছোট। সবার বড় বোন নীলমণি সরেন, বড় ভাই সুন্দর সরেন ও মেজো ভাই বুধরায় সরেন। তিন ভর্তি হন বারকোণা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পার্বতীপুর হাবড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। দিনাজপুর সংগীত কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক। রাজশাহীর শাহ মখদুম কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করার পর রাজশাহী ল কলেজে ভর্তি হন।
কিশোর বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথ আদিবাসী গ্রাম পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। ছাত্রজীবনে বামপন্থি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তরুণ বয়সে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ নিয়ে খুঁজে বেড়ান নাচোলের তেভাগা কর্মীদের। ১৯৯৩ সালে গড়ে তোলেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ। উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চল, চা বাগান এবং ঢাকাতেও সম্প্রসারিত হতে থাকে সাংগঠনিক তৎপরতা। আদিবাসী পরিষদের ৯ দফা দাবি প্রণয়নে তাঁর ভূমিকা অনন্য। দিনাজপুর-৬ আসন থেকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেন। তাঁর অনুপ্রেরণা এবং তৎপরতায় ২০০৩ সালে ‘আদিবাসী সাংস্কৃতিক পরিষদ’, ২০০৮ সালে ‘আদিবাসী ছাত্র পরিষদ’, ২০১১ সালে ‘আদিবাসী যুব পরিষদ’ এবং ২০১২ সালে গঠিত হয় ‘আদিবাসী নারী পরিষদ’। ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’, জনপ্রিয় ব্যান্ড গানের দল ‘মাদল’সহ বহু স্থানীয় ও জাতীয় সংগঠন গড়ে তুলতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি, কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন, ‘খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ’ জাতীয় কমিটির সদস্য হিসেবে আমৃত্যু তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতিসংঘে আদিবাসী স্থায়ী ফোরামে যোগদানের মাধ্যমে বৈশ্বিক আদিবাসী আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
ভূমি ও প্রকৃতি সুরক্ষার স্বপ্ন
সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠনের দাবি ও আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বহু রাজনৈতিক দল নির্বাচনী ইশতেহারেও এ দাবিকে অঙ্গীকার হিসেবে গ্রহণ করেছে। ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট নওগাঁর ভীমপুরে ভূমি রক্ষা করতে গিয়ে খুন হন আলফ্রেড সরেন। রবীন্দ্রনাথ সরেন ‘আলফ্রেড সরেনের ভূমি আন্দোলন’কে দেশব্যাপী পরিচিত করে তুলতে ভূমিকা রেখেছেন। তাঁরই সহযোগিতায় এ নিয়ে আরণ্যক নাট্যদল ‘রাঢ়াঙ’ নাটক তৈরি করে। তাঁর সক্রিয়তায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি রক্ষা আন্দোলন শুরু হয় ২০১৬ সালে। একই বছরের ৬ নভেম্বর এ আন্দোলনে গুলি চালালে শহীদ হন শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু। ফুলবাড়ী উন্মুক্ত কয়লা খনির আগ্রাসন প্রথম রুখে দাঁড়ান রবীন্দ্রনাথ স্থানীয় আদিবাসী ও গ্রামের বাঙালিদের নিয়ে। পরে এটি জাতীয় সংগ্রামে রূপ নেয়। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ী এশিয়া এনার্জি কোম্পানির অফিস ঘেরাও কর্মসূচিতে সহস্র জনতাকে সংগঠিত করার নেতৃত্ব দেন। ফুলবাড়ী, আলফ্রেড সরেন ও বাগদাফার্ম রবীন্দ্রনাথ সরেনের তিনটি উল্লেখযোগ্য পাবলিক আন্দোলন।
থামতে দেখিনি কখনও
মাত্র ৬৭ বছরের জীবনে তাঁকে থামতে দেখেনি কেউ। রাতবিরেত, দিনদুপুর, শীত-বর্ষা, গ্রাম-শহর– সর্বত্র তিনি ছুটে গেছেন রক্তপাত ও আগুনের ভেতর। দাঁড়িয়েছেন বন্দুক ও বাহাদুরির সামনে। প্রচারপত্র, পোস্টার, চিঠি, স্মারকলিপি, অবস্থানপত্র তৈরিতে ছিলেন সচেতন। ১৯৯৬ সাল থেকে অবদান রেখেছেন। ২০০৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীতে ভূমি রক্ষায় আয়োজন করেন দীর্ঘ গণপদযাত্রার। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে এক লাখ গণস্বাক্ষর নিয়ে ২০১০ সালের ১০ ডিসেম্বর মানববন্ধন করেন জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে। ২০১১ সালে তাঁর উৎসাহে সবিন চন্দ্র মুন্ডা ও নরেন পাহান শুরু করেন ‘জাতীয় মুন্ডা সম্মেলন’ ২০১১। ভূমি অধিকারের দাবিতে ২০২২ সালে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে বিশাল গণকর্মসূচির আয়োজন করেন। নানা সময়ে ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেও তিনি কাউকে বুঝতে দেননি। চিকিৎসার নামে দিনাজপুরে তাঁর পায়ের তিনটি আঙুল কেটে ফেলেন ডাক্তার। অসুস্থ অবস্থায় রাজনীতিবিদ পংকজ
ভট্টাচার্যের নির্দেশে তাঁকে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করা হয়। কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু কী নিদারুণ! আবার অসুস্থতায় কিছুদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর বাড়ি ফিরে গিয়ে হঠাৎ তীব্র শীতের রাতে সব শেষ।
পাভেল পার্থ : লেখক ও গবেষক
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: