• ঢাকা
  • বুধবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ০৮ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

শিক্ষায় আনন্দ-নিরানন্দ


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০৩:১৬ পিএম
শিক্ষায় আনন্দ-নিরানন্দ
শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম

অজয় দাশগুপ্ত :

সরকার দুই হাজার ৭১৬টি স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ঈদের উপহার দিয়েছে- এসব প্রতিষ্ঠান এপিওভুক্ত হয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে প্রায় ৬ হাজার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য সরকারের সিদ্ধান্ত গভীর হতাশার কারণ হয়েছে- এ সব প্রতিষ্ঠান এপিওভুক্ত হওয়ার আবেদন করেছে, কিন্তু তা গৃহীত হয়নি। না হওয়াদের দলে যারা, তাদের নাকি অনেক ‘খরচাপাতি’ হয়েছে। কিন্তু সবটাই যে জলে গেল! এ প্রক্রিয়ায় লাভবান হলো কারা?

ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে পড়েছি। আমাদের বিদ্যালয়টি সে সময়ে ষাট বছরের বেশি সময় অতিক্রম করে এসেছে। সেখানে পড়াশোনার মান ভালো ছিল। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তিন জন বোর্ডে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছিল। প্রতি বছর একাধিক ছাত্র প্রথম বিভাগ পেত। কিন্তু  শিক্ষকরা নিয়মিত বেতন পেতেন না।

‘বুদ্ধিমান কিংবা চালাক-চতুর’ শিক্ষকদের দেখেছি, সচ্ছল পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের বলতেন- ‘তোমরা বেতনের টাকা অফিসে না দিয়ে আমাকে দেবে। আমি অ্যাডজাস্ট করে নেব।’ সংসার চালাতেই এমন অসাধু পন্থা অবলম্বন করা হতো। এটা যারা পারতেন না তারা শিক্ষকদের সভায় অভিযোগ করতেন। আমি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে ও পরে ৫ মাস ওই বিদ্যলয়ে শিক্ষকতা করেছি। মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পেয়েছি। নবম-দশম শ্রেণিতে অংক, ইংরেজি, বিজ্ঞান পড়াতে পারতাম। তারপরও মাসে বেতন নির্ধারিত ছিল ৫০ টাকা। কোনো মাসেই পুরো বেতন পাইনি।

তখনও শিক্ষকরা সরকারি তহবিল থেকে কিছু অর্থ পেতেন। যখন এ অর্থ বিদ্যালয়ে পৌঁছাত, শিক্ষকরা দারুণ খুশি হতেন- কয়েকটা দিন ভালো থাকা যাবে!

এখন চিত্র ভিন্ন। সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা সরকারের তহবিল থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা পান। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও এ সুবিধার আওতায় এসেছেন। তবে বৈষম্য রয়েছে বাড়ি ভাড়ার হারে। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে বঞ্চিতদের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ঘোষণা অবশ্য সবার সন্তুষ্টির কারণ হয়েছে, যখনই নতুন পে-স্কেল হবে শিক্ষকরা আপনা আপনি তার আওতায় আসবেন।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে। এতে চার জন অভিভাবক প্রতিনিধি থাকেন, আরেকজন থাকেন বিদ্যোৎসাহী। ম্যানেজিং কমিটির প্রধান কে হবেন, সেটা নির্ধারণে স্থানীয় সংসদ সদস্যর প্রভাব খাটানোর সুযোগ রয়েছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা কাজে লাগানো হয় বলেই সাধারণভাবে ধারণা। সরকার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেয়। পাশাপাশি দেয় বিনামূল্যে বই।

বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ ও সংস্কার, বিজ্ঞান গবেষণাগার স্থাপন, কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন, খেলাধুলার সরঞ্জাম সরবরাহ- এ সব ক্ষেত্রেও সরকারের বরাদ্দ পাওয়া যায়। অনেকের অভিযোগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারের বরাদ্দ যত বাড়ছে, এর সুযোগ নিতে সক্রিয় ‘বিদ্যোৎসাহীর’ সংখ্যাও বাড়ছে। ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হওয়ার জন্য তারা তৎপর থাকে। সংসদ সদস্যর আনুকূল্য মেলে যাদের, তারা সভাপতি হয়ে যান। পড়াশোনার মান বাড়ানো, না-কি বিদ্যালয়ে সরকারি বরাদ্দে ভাগ বসানো, কোনটিকে তারা প্রাধান্য দেন, সেটা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে।

চলতি বছরে ১৯ লাখের বেশি ছাত্রছাত্রীর মাধ্যমিক বা এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা। এ সংখ্যা উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু কতটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েছে কি-না সেটা নিয়ে পর্যালোচনায় বসে? প্রতি বছর শত শত প্রতিষ্ঠানে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল খারাপ হয়। কিছু প্রতিষ্ঠানে কেউ পাস করে না। তাহলে বছরের পর বছর তাদের কী পড়ানো হলো? এ নিয়ে কি সব ম্যানেজিং কমিটিতে আলোচনা হয়?

কয়েক বছর আগে একটি গ্রামের কয়েকজন শিক্ষক বলছিলেন তাদের দুর্ভাগ্যের কথা। বিদ্যালয়ে নিয়োগের জন্য যত ধরনের পরীক্ষা দিতে হয়, সবগুলোতে তারা উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি তাদের হুমকি দিচ্ছে। তারা বলছে, আমরা কয়েকজনের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছি নিয়োগদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু তারা নিয়োগ পান নাই। তাদের কাছ থেকে নেয়া অর্থ খরচ হয়ে গেছে। নিয়োগ না পাওয়ায় সে অর্থ ফেরত দিতে হবে। এখন আপনাদের দায়িত্ব ওই অর্থ পরিশোধ করা। অন্যথায় আপনাদের এখানে শিক্ষকতা করা কঠিন হবে।

এ ধরনের অভিযোগ শহর ও গ্রামে মিলবে অনেক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কি তা অজানা?  আমি মনে করি শিক্ষকতা পেশা আরও আকর্ষণীয় করার জন্য বেতন-ভাতা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি শিক্ষকদের সম্মানের প্রতিও বাড়তি নজর দিতে হবে। সম্প্রতি শিক্ষকদের একটি সমাবেশে বলেছি, প্রধান শিক্ষকের বেতন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার চেয়েও বেশি হওয়া উচিত। প্রধান শিক্ষকের পদ পেতে কাউকে ১৫-২০ বছর শিক্ষকতা করতে হয়। শিক্ষকের বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা যথেষ্ট হলে সেরা ছাত্রছাত্রীরা এ পেশায় আসতে উৎসাহবোধ করবেন। আর সেরা ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে নিয়োগ পেলে শিক্ষার মান বাড়বে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য মিলবে দক্ষ ও যোগ্য কর্মী। এ জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথা থাকা দরকার। বাস্তবে কতটি প্রতিষ্ঠানে সেটা রয়েছে?

এমপিওভুক্তির জন্য অর্থের লেনদেন হয়, এটা ওপেন সিক্রেট। সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেয় প্রতি বছর। কিন্তু নোট বই ও গাইড বই স্কুলে স্কুলে গছিয়ে দিতে একটি চক্র তৎপর। শিক্ষক-ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের এ জন্য হাত করতে হয়। এর উপায় নোট বই ও গাইড বইয়ের প্রকাশকদের জানা আছে বৈকি!

সম্প্রতি রাজধানীর একটি কলেজে একজন রাজনৈতিক নেতা ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি প্রথম দিন বিপুল সংখ্যক সমর্থক নিয়ে কলেজে উপস্থিত হয়ে তার শক্তি-সামর্থ্যরে পরিচয় দিয়েছেন। এটাও বাস্তবতা যে শহর ও গ্রামের সর্বত্রই স্কুল-কলেজের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী স্থানীয় ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ না জানিয়ে উপায় থাকে না। যেখানে ‘প্রভাবশালী’ মহলে দলাদলি আছে, সেখানে অনুষ্ঠান করা খুবই কঠিন। আমি নিজে ফরিদপুরের একটি বিদ্যালয়ে দেখেছি, বার্ষিক খেলাধুলার আয়োজনে সংসদ সদস্যর সঙ্গে অন্তত ৫০ জন যুবক এসেছিল মোটরসাইকেল নিয়ে। তাদের নাস্তা ও দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষকে। স্কুলের ফান্ড সেরাদের ভালো পুরস্কার দিতে যতটা ব্যয় হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ব্যয় আপ্যায়নে!

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ সব জানে না, সেটা বলা যাবে না। তাদের এটাও জানা যে শত শত স্কুল-কলেজে প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ পদ শূন্য। কাজ চালানো হয় ‘ভারপ্রাপ্ত’ দিয়ে। যোগ্য লোক বছরের পর বছর মিলবে না, এটাই কি বাস্তবতা? অভিজ্ঞ মহলের ধারণা, ‘ভারপ্রাপ্তদের’ দিয়ে অনেক অনিয়ম সহজেই করিয়ে নেয়া যায় বিধায় এ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হয়।

এ সব সমস্যা নিয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সংগঠনের নেতারা আলোচনা করেন, সেটা জানি। কিন্তু এটাও জানা যে তারা বেতন-ভাতার সমস্যা নিয়ে যতটা কথা বলেন, শিক্ষার মান বাড়ানোর বিষয় নিয়ে আলোচনায় ততটা উৎসাহী না। পাঠ্যসূচির বিষয় নিয়েও তারা তেমন সোচ্চার নন।

ছাত্র সংগঠনগুলোর ভাবনাতেও শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা রাজনীতিতে বেশি মগ্ন। প্যারেন্ট পার্টির যখন যেটা এজেন্ডা সেটা নিয়ে তারা সামর্থ্য অনুযায়ী সোচ্চার। শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের বাড়তি  ‘দায়িত্ব’ আছে, নির্মাণ কাজ ও নিয়োগ বিষয়ে তাদের খোঁজ-খবর রাখতে হয়। এ যে জাতীয় দায়িত্ব!

অথচ এখন ঘরে ঘরে শিক্ষার্থী। প্রায় পাঁচ কোটি ছাত্রছাত্রী পড়ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। বস্তিবাসী, কৃষক-ক্ষেতমজুর পরিবারের সন্তানেরা পড়ছে। শিক্ষায় সরকারের বরাদ্দ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হলেও পরিমাণে প্রতি বছর বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও চাহিদা বাড়ছে দক্ষ জনশক্তির। শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রভাবশালী মহল এ সব বিষয়ে কবে মনোযোগী হবে?

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন

আরো পড়ুন

banner image
banner image