অলোক আচার্য :
আজ থেকে দুই তিন যুগ আগেও বাংলাদেশে সহজে দেখা মিলতো না শামুকখোল পাখির। উপযুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত খাবার এবং প্রজনন সুবিধার কারণে এই পাখি এখন বাংলাদেশের আনাচে কানাচে দেখা মিলছে। এতে লাভ হয়ে আমাদেরই। একটি পাখির বাসস্থান গড়ে উঠেছে। শামুকখোল পাখির ইংলিশ নাম Asian Open-bill ev Open-bill Stork এবং বৈজ্ঞানিক নাম Anastomus oscitans। এই পাখির ঠোঁটের সাথে অন্য কোন পাখির ঠোঁটের মিল নেই। শামুকখোল পাখির ঠোঁটের নিচের অংশের সাথে উপরের অংশে বড় ফাঁক। এরা এই বিশেষ ঠোঁটে শামুক তুলে চাপ দিয়ে শামুকের ঢাকনা খুলে ফেলে এবং ভিতরের নরম অংশ খেয়ে নেয়।
মূলত শামুকের ঢাকনা খোলার শৈল্পিক কৌশলের কারণেই এই পাখির নাম করণ করা হয়েছে শামুকখোল পাখি। শামুকখোল হাওর, বিল, মিঠাপানির জলা, হ্রদ, ধানক্ষেত, উপকূলীয় প্যারাবন ও নদীর পাড়ে বিচরণ করে। সচরাচর ছোট ঝাঁকে থাকে। বড় কলোনিতে রাত্রিবাস ও প্রজনন করে। খাবারের অভাব না হলে এরা সাধারণত এক জায়গা থেকে নড়ে না। কমবয়েসী শামুকখোলেরা উড়তে শেখার পর বিশাল অঞ্চল পরিভ্রমণ করে। বর্ষাকালের শেষ দিকে শামুকখোলের প্রজনন ঋতু শুরু হয়। মূলত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস এদের প্রজনন মৌসুম। স্থানভেদে প্রজনন ঋতুতে বিভিন্নতা দেখা দেয়। যে বছর খরা হয়, সে বছর এরা সাধারণত প্রজনন করে না।
এ সময় এরা গোঙানির মত শব্দ করে ডাকে ও ঠোঁটে ঠক্ ঠক্ করে শব্দ তোলে। শামুকখোলের দেহের দৈর্ঘ্য ৬৮ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার। ওজন ২.৩ থেকে ৪.৪ কেজি। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে একই রকম। প্রজননকালে এদের মাথা, গলা, পিঠ, বুক ও ডানার ওপরের পালক ধবধবে সাদা দেখায়। কাঁধ-ঢাকনি, ডানার প্রান্ত-পালক, মধ্য-পালক ও লেজ হয় সবুজে কালো। চোখ সাদা, ধূসর বা হালকা বাদামি।
এদিকে শামুকখোল পাখির রাজ্য হয়ে উঠেছে চর-নাকালিয়া গ্রাম। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য আর নির্জন পরিবেশে এখানে প্রায় সাত থেকে আট বছর ধরে বাস করছে শামুকখোলসহ নানা প্রজাতির পাখি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন জোনাকির আলো জ্বলজ্বল করেছে। প্রতিটি গাছের মগডালে উঁকি দিচ্ছে অসংখ্য শামুকখোল পাখি। সারাক্ষণ চলে ওদের ডানা ঝাপটানো ও কক কক শব্দ। কেউ বা উড়ে যাচ্ছে খাবার সংগ্রহ করতে আবার কেউ খাবার মুখে নিয়ে এসে তুলে দিচ্ছে বাচ্ছার মুখে। সারাদিন চলে তাদের এই কর্মযজ্ঞ। সন্ধ্যায় পুরো এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে পাখির কল কলতানিতে। নির্বিঘ্নে রাত কাটিয়ে ভোর হলেই উড়ে যায়। দিন শেষে আবারও তারা নীড়ে ফিরে আসে।
বেড়া উপজেলার সদর থেকে সাত থেকে আট কিলোমিটার দূরে যমুনা নদীর পূর্বপার ঘেসে গড়ে উঠেছে চর-নাকালিয়া গ্রাম। এই গ্রামের বিভিন্ন প্রজাতির গাছের ডালে আশ্রয় নিয়েছে ধূসর ও কলো বর্ণের শামুকখোলসহ পাখি। গ্রামের পার্শ্ববর্তী যমুনা নদী ও শাখা নদী আর ফসলের মাঠ থেকে নানা জাতের পোকামাকড় ও শামুক ঝিনুক খেয়ে জীবন ধারণ করে এই পাখিগুলো।
চর-নাকালিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ হযরত আলী, বাবু প্রাং ও সিপন মিয়া বলেন, আমাদের কাছে এই পাখিগুলো পরিবারের সদস্যে পরিণত হয়েছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে গ্রামে প্রবেশের পথে যদি সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরন ও সচেতনমূলক ব্যানার কিংবা সাইনবোর্ড টানিয়ে এই অঞ্চলকে পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তাহলে হয়তো পাখি শিকার বন্ধ হতো এবং বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির পাখিগুলো এই অঞ্চলেই প্রজনন ও বংশবিস্তার করতে পারত।
দর্শনার্থী শ্রী বুদ্ধিস্বর সহ অনেকেই বলেন, লোকমুখে শুনে এই পাখিগুলো দেখতে এসেছি। হাজার পাখির সমাবেশ ও কলতানিতে মুখরিত স্থানটি খুবই সুন্দর লেগেছে। কিন্তু পাখিগুলোর নিরাপত্তার জন্য সরকারি ভাবে দ্রত পদক্ষেপ গ্রহন করা উচিত। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন কামনা করছি। সঠিক পদক্ষেপই এই পাখিগুলোকে জাতীয় সম্পদে পরিণত করতে পারে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন
আপনার মতামত লিখুন: