নিউজ ডেস্ক: প্রায় এক দশক পর ঢাকায় এক সমাবেশ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনায় এসেছে জামায়াতে ইসলামী। মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে জামায়াত ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার একটা জোরালো দাবি যেখানে রয়েছে সেখানে সরকার রাজনৈতিক সভা সমাবেশের অনুমতি কেন দিল সে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের।
নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতের মাঠের রাজনীতিতে ফেরার এই কর্মসূচীকে ঘিরে চলছে নানা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। জামায়াতকে ঢাকায় সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া নিয়ে সরকারের মন্ত্রীরা ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য রেখেছেন।
ওই সভার অনুমতির পেছনে জামায়াতের জনসমর্থন, রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের বৈধতা থাকা এবং রাজনৈতিক কারণও উল্লেখ করা হয়েছে।
জামায়াতকে কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হলো তা নিয়ে বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতেরও আলাদা ব্যাখ্যা রয়েছে।
জামায়াত কী বলছে
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার শুরুর পর গত প্রায় দশ বছরে জামায়াত রাজপথে সভা-সমাবেশ করার অনুমতি পায়নি। তবে দলটি বিভিন্ন সময় ঝটিকা মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ করে কর্মসূচী পালন করেছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা ঘরোয়া বৈঠক করতে গিয়েও প্রশাসনের চাপ এবং মামলা হয়রাণি ও গ্রেপ্তারের মুখোমুখী হয়েছেন।
এখন সমাবেশের অনুমতির পেছনে সরকারের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়া আছে কি না? এ প্রশ্নে জামায়াতের মূখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে কোনো আলাপ আলোচনার বিষয়টি পুরোপুরি নাকচ করে দেন।
“আওয়ামী লীগের সাথে বা সরকারের সাথে জামায়াতের কোনো যোগাযোগ নাই। কারণ জামায়াতে ইসলামীর সাথে যোগাযোগের সকল রাস্তা সরকার বন্ধ করে রেখেছে। সরকারের সাথে কোনো আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে আমাদের এই প্রোগ্রাম হয় নাই।”
জামায়াত বলছে সরকার এই অনুমতি দিতে বাধ্য। মি. আকন্দের ভাষায়, “আসলে সরকারতো এটা সবসময় দিতে বাধ্য। এটাতো সাংবিধানিক অধিকার। ওনারা এতদিন এই অধিকারটা না দিয়ে অসাংবিধানিক কাজ করেছেন এবং অগণতান্ত্রিক কাজ করেছেন, আমাদের অধিকার পরিপন্থী কাজ করেছেন। সরকার এখন দিতে বাধ্য হয়েছে কারণ সামনে নির্বাচন।”
বিএনপির মূল্যায়ন
জামায়াতকে দশ বছর পর সমাবেশের অনুমতি দেয়া নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় কোনো বক্তব্য তুলে ধরেনি বিএনপি। বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, এই সময়ে জামায়াতকে সভার অনুমতির দেয়ার পেছনে দুটি কারণ রয়েছে।
“একটি হলো সরকারি দল চাচ্ছে জামায়াতের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে। আর সম্প্রতি যে ভিসানীতি দিল যুক্তরাষ্ট্র, আমি মনে করি সেটারও একটা প্রভাব এখানে আছে। যেমন ওখানে বলাই আছে যে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে যদি বাধাগ্রস্ত করেন। এখন এই মিটিং মিছিল এটাতো নির্বাচনী প্রক্রিয়ারই একটা অংশ।”
“নির্বাচনেরও সর্বোচ্চ ছয় মাস বাকী। তাই আমি মনে করি এখানো দুটো জিনিস কাজ করেছে, একটা হলো জামায়াতকে বিএনপি থেকে একটু দূরে সরানো সরকারি দল কর্তৃক আরেকটা হলো ভিসা রেস্ট্রিকশন যেটা বলতেছে তার একটা সুফলও বলতে পারেন প্রভাবও বলতে পারেন” মি. মিন্টু।
সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হতে একাধিক জোট গঠিত হলেও তার কোনোটিতেই নেই জামায়াত। বিএনপির সঙ্গেও আনুষ্ঠানিক কোনো যোগাযোগ হচ্ছে না দলটির। এ অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে কিনা এ প্রশ্নে আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন,
“জামায়াতের সাথে আমাদেরতো দূরত্ব হওয়ার কোনো দরকার নাই। আমি মনে করি দেশের স্বার্থে আমাদের বরং ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করে দেশের মানুষের অধিকার ফেরত আনাই এখন সবার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।”
সরকারি দলের অবস্থান
সরকারের অনুমতি পেয়ে দীর্ঘদিন পর ঢাকায় বড় শোডাউন করে দেখিয়েছে জামায়াত। নির্বাচনের আগে বর্তমান রাজনৈতিক পটভূমিতে একে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া নিয়ে অনেকেই সন্দেহ করছেন যে সরকারি দলের সঙ্গে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠছে কি না।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় অবস্থান জানতে চাইলে দাবি করা হচ্ছে, জামায়াতকে কোনো ছাড় দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতের ব্যাপারে দলের নীতিগত অবস্থানও পরিবর্তন হয়নি। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল-আলম হানিফ বিবিসিকে বলেন,
“১৯৭১ সালে তাদের যে ভূমিকা ছিল সেটা অমার্জনীয়। তারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এই দলের সাথে আওয়ামী লীগের কখনো কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। হতে পারে না।”
মি. হানিফ বলেন, “ জামায়াত অনেকটা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। যদিও তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার জন্য হাইকোর্টে একটা মামলা বিচারাধীন আছে আমরা প্রত্যাশা করছি যে এই মামলাটা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। কারণ এই দলের বাংলাদেশে রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার থাকাটা যুক্তিযুক্ত নয়।”
আন্দোলনে জামায়াতের অবস্থান
জামায়াতের তাদের সমাবেশ থেকে যে তিনটি প্রধান দাবি তুলেছে তার মধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্যতম। জামায়াতের এ অবস্থান সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির জন্য সহায়ক।
বিএনপির নেতৃত্বে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনেও মাঠে নেমেছিল জামায়াত। তবে বিএনপির আন্দোলনের গতি প্রকৃতি নিয়ে একটা ক্ষোভ উঠে এসেছে জামায়াতের মূখাপত্রের বক্তব্যে। এ ব্যাপারে মতিউর রহমান আকন্দ বলেন,
“২০২২ সালের ১০ই ডিসেম্বর বিএনপি গোলাপবাগ মাঠ থেকে আর জামায়াতে ইসলামীর আমীর সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখার মাধ্যমে যুগপৎ কর্মসূচী ঘোষণা করলেন। দুই দিন পর ডা. শফিকুর রহমান সাহেব অ্যারেস্ট হয়ে গেলেন। এটাতো যুগপৎ আন্দোলনের জন্যই হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচী না দিলে তিনি অ্যারেস্ট হতেন না। কিন্তু আমরা দেখলাম যে বিএনপি এরপরে নীরব।”
জামায়াত স্পষ্ট করেই বলছে যে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এবং বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনেও অংশ নেবে না জামায়াত। তত্ত্বাবধায় সরকারের দাবিতে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচী নিয়ে দলটি কীভাবে এগুতে চায় সেটি স্পষ্ট হতে চায় জামায়াত। মতিউর রহমান আকন্দ বলেন,
“যুগপৎ আন্দোলন করার জন্য নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে বিএনপি আসলে এ আন্দোলন সম্পর্কে কী করতে চায় এটা তাদেরকে পরিস্কার করতে হবে। জামায়াতে ইসলামী আন্দোলনমুখী দল, আন্দোলনমুখী আছে এবং আন্দোলনমুখী থাকবে।”
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত
মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের সাজা, প্রকাশ্য রাজনীতিতে দীর্ঘ অনুপস্থিতি, নিবন্ধন বাতিল এবং সরকারের নানামুখী চাপে থাকার পরেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বিশেষ অবস্থান ধরে রেখেছে জামায়াত। গত প্রায় ৫ দশক ধরে দলটি নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে কখনো বিএনপি অথবা আওয়ামী লীগের সাথে এক ধরনের বোঝাপড়া করে রাজনীতি করে আসছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতিতে নানা পালাবদল দেখা গেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে দেশ স্বাধীন হবার পর পরই নিষিদ্ধ হয় জামায়াতের রাজনীতি। এরপর বিএনপির প্রতিষ্ঠা ও জিয়াউর রহমানের শাসনামলে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ১৯৭৭ সালে পূণরায় রাজনীতিতে ফেরে জামায়াত। আশির দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে মাঠে থাকা জামায়াত ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন করে।
আবার ৯৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যৌথভাবে রাজপথে আন্দোলন করেছে জামায়াত। আর ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে চারদলীয় জোটের অংশ হয়ে বিএনপির নেতৃত্ব নির্বাচনে জিতে জোট সরকারে অংশ নেয় দলটি। সবশেষ ২০১২ সাল থেকে বিএনপির সাথে ২০ দলীয় জোটের শরিক হয়ে রাজনীতি করে জামায়াত যে জোট আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙ্গে যায় ২০২২ সালে।
২০১৩ সালে দেয়া হাইকোর্টের এক রায়ের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আদালতে আপিল করেছে জামায়াতে ইসলামী যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
ঢাকানিউজ২৪.কম /
আপনার মতামত লিখুন: