সুমন দত্ত: বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিদেশি দেশগুলোর মন্তব্য অযাচিত নয়। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগই ২০০৮ সালে বিদেশিদের সাহায্য নিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন। দেশবাসী সেই ইতিহাস ভুলে যায়নি। সেদিন বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে শেখ হাসিনা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বারস্থ হোন, আমেরিকায় যান। পরিশেষে ভারতে গিয়ে দেন দরবার শেষ করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব বেশি। যে কারণে এবার ভারত আগে ভাগেই বলে দিয়েছে শেখ হাসিনাকে নিয়ে তারা কোনো দেশের সঙ্গে দেন দরবার করবে না। ভারত হয়ত নিজে থেকে করবে না। তবে শেখ হাসিনা হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তিনি সেপ্টেম্বরে ভারত যাবেন। সেখানে তিনি ক্ষমতায় বহাল থাকার জন্য দেন দরবার করবেন। ভারতের প্রভাব খাটিয়ে, মার্কিন চাপকে পাশ কাটিয়ে, তিনি আরেকটি পাতানো নির্বাচন করে, আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন।
শেখ হাসিনা জানেন মার্কিন চাপে পড়ে সুষ্ঠু নির্বাচন দিলে ফেল নিশ্চিত। আর ফেল করলে কি পরিণতি হবে, সেটাও তিনি আচ করতে পারেন। যেই কৌশলে তিনি গত ১৪ বছর বিরোধী দলকে দমিয়ে রেখেছেন, ঠিক একই কৌশলে তাকে ও তার দলকে দমিয়ে রাখবে নির্বাচিতরা। সেটা ভেবেই তিনি ত্রাহি মাম, ত্রাহি মাম, করতে করতে ভারত যাবেন এবং মোদির সাহায্য চাইবেন। এখন দেখার বিষয় মোদি তাকে সাহায্য করে কিনা, কিংবা করলে, মোদি কতটুকু করবেন।
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন কীভাবে হবে। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে? নাকি ক্ষমতাসীন দলের নেত্রীর অধীনে হবে? এ নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম। এসব নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। যদি বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ তথা প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করত।
একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ আজও প্রতিষ্ঠিত হলো না। এখনো বিচারকদের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা বদলি প্রমোশন আইন মন্ত্রণালয় থেকে পারিচালিত হয়। বিচার বিভাগের খরচ আসে নির্বাহী বিভাগ থেকে। প্রধান বিচারপতি নামেই। সরকারের বিরুদ্ধে গেলে তার চাকরি হাওয়া। এস কে সিনাহ কান্ডের পর বাংলাদেশে কোনো বিচারপতি সরকারের বিরুদ্ধে যাবে না।
পৃথিবীর সব দেশে এই দুটি (বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ) স্তম্ভ নিরপেক্ষভাবে জনগণ কে সার্ভিস দেয়। বাংলাদেশেই হচ্ছে এর ব্যতিক্রম। এখানে বিচার বিভাগ ও প্রশাসন ক্ষমতাসীন সরকারের দল দাসে পরিণত হয়। রাষ্ট্রের দাস না হয়ে তারা বিশেষ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর দাস হয়ে কাজ করে থাকেন। যে কারণে আজ অন্য দেশের মতো নির্বাচন হয় না বাংলাদেশে।
২০১৪ সালে ১৫৩ টি আসনে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। সেবার প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের দাস হয়ে ঠুনকো কারণে বিরোধী দলগুলোর মনোনীত প্রার্থীদের বাদ দিয়েছে। সেবার যেভাবে চিরুনি তল্লাশি করা হয়েছিল বিরোধী দলের মনোনয়ন গুলোকে বাতিল করতে, সেভাবে সরকারি দলের মনোনয়নগুলোর ক্ষেত্রে হয়নি। যার ফলে অধিকাংশ আসনে ভোট না করেই সরকারি দলের প্রার্থী পাশ।
২০১৮ সালে এই ঘটনা ঘটেনি। তবে ঘটল অন্যভাবে। এবার প্রশাসনের লোকরা ভোটের আগের দিন রাতে নিজেরাই ভোট দিয়ে পরের দিন বিরোধী পক্ষের ভোটারদের সারাদিনের জন্য ভোট কেন্দ্রের দরজায় আটকে রাখে। কেন্দ্রে গিয়ে কেউ ভোট দিতে পারেনি। পুরো প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখে পুলিশ প্রশাসন। বলতে গেলে তাদেরই হাত ধরে এভাবে নকল করে পাশ করে বর্তমান সরকার। আর সেই নকলকে সিল মোহর দেয় বিসিএস পাশ করে আসা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।
আজ যদি নির্বাচন কমিশন এ ধরনের জালিয়াতিকে প্রশ্রয় না দিত। তারা ২০১৮ সালের নির্বাচনকে বাতিল করে নতুন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করত, তাহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা দেশবাসীর কাছে তথা বিশ্ববাসীর কাছে বেড়ে যেত। সেই ক্ষমতা এদেশের নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের ছিল। কিন্তু তারা সেটা প্রয়োগ করেনি। নিজেদের লোভ লালসার খপ্পরে পড়ে তারা এসব কাজ করেছেন। যার ফল বইতে হচ্ছে এদেশের সাধারণ জনগণকে।
নকল করে পাশ করা দল রাষ্ট্র চালাতে চোর চোরটারই সাহায্য নিবে। যে কারণে আজ বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরি যায়। শেয়ার মার্কেট লুট হয়ে যায়। ব্যাংক লুট হয়ে যায়। এভাবে দেশের হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। যার পরিণতিতে দেশের মানুষের ঘাড়ে চাপে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলের বোঝা,উচ্চ দামে নদীর পানি কিনতে হয়, গ্যাস না দিয়ে হাওয়া বিক্রি করে টাকা কামাই করে তিতাস, টেলিফোনের তার চুরি করে গ্রাহককে সেবাহীন রাখে বিটিসিএল। নিত্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অর্পিত সম্পত্তির ভাড়া ৬০০ পারসেন্ট বাড়াতে হয়, জমি ও ফ্লাট রেজিস্ট্রেশন কয়েকগুণ বাড়াতে হয়। ।
অন্যদিকে মধ্যবিত্তের পুজি যেখানে বিনিয়োগ, সেই সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমিয়ে দেওয়া হয়, সঞ্চয়পত্র ওয়ালাদের ভোগান্তি বাড়াতে ইনকাম ট্যাক্স অফিসে দৌড়ানি দিতে হয়। এই হচ্ছে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন।
এই সরকার সাধারণ মানুষের সুযোগ সুবিধা কমিয়ে চোর ডাকাতের অধিকার বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ তারা তো চুরি ডাকাতি করেই ক্ষমতায় টিকে আছে। তাই চুরি আর ডাকাতিই হচ্ছে তাদের আদর্শ। এই চুরি ডাকাতি করেই তারা ক্ষমতায় থাকতে চায়। এদেশের জনগণ নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ পেলে তাদের অবস্থান কোথায় সেটা দেখিয়ে দেবে।
বলা হয়ে থাকে মিডিয়া গণতান্ত্রিক দেশে চর্তুথ স্তম্ভ। এবার আসুন বিচার করি বাংলাদেশে মিডিয়ার মালিক কারা? এরা সারা বছর কি করে, কি সংবাদ প্রচার করে। যাদের সহযোগিতায় বাংলাদেশে লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের অধিকাংশ হচ্ছে এই মিডিয়ার মালিক। বাংলাদেশে বহুল আলোচিত শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি। কয়েকবার এই কেলেঙ্ককারি হয়। যার অন্যতম হোতা ছিলেন দরবেশ বাবা তিনি বেক্মিমকো গ্রুপের মালিক। তিনি একাধারে এমপি, প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ উপদেষ্টা। তিনি ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার মালিক। অনলাইন জগতে বিডিনিউজ২ডটকম তাদের মিডিয়া (ভুল হলে ক্ষমা করবেন)। এছাড়া এদেশে একচেটিয়া ডিটিএইচ ব্যাবসা করছে এই গ্রুপের কোম্পানি। উচ্চ আদালতে তার নামে মামলা এখানো পেনডিং অবস্থায় পড়ে আছে। যা শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারির সময় হয়েছিল।
এরপর বাংলাদেশে মিডিয়া মুগল হিসেবে পরিচিত এক ভূমিদস্যুর নাম আসে। যার নাম বসুন্ধরা। মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে তাকে ভূমিদস্যু হিসেবেই বেশিরভাগ সাংবাদিক চিহিৃত করত। যেই তিনি মিডিয়া দিলেন, সব সাংবাদিক ভূমিদস্যু বলা থেকে নীরব হয়ে গেল। এই দেখে এই লোক বাজারে বেশ কয়েকটি মিডিয়া দিলেন। যেখানে কাজ করছে হাজারো সাংবাদিক। বর্তমানে সাংবাদিক সংগঠনগুলো ও প্রেসক্লাব বসুন্ধরা গ্রুপের মিডিয়ার লোকজনদের দখলে। ভূমিদস্যুর মিডিয়াগুলো হচ্ছে নিউজ২৪, বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কন্ঠ, টি স্পোর্টস, ডেইলি সান। বাংলাদেশে এমন কোনো ব্যবসা নাই এই প্রতিষ্ঠান না করে। জ্বালানী তেল থেকে নিত্যপন্য সব ব্যবসা এই গ্রুপের। বাংলাদেশে এদের এমন অসীম ক্ষমতা শুরুতে ছিল না। বিগত ১৪ বছর আওয়ামী লীগ আমলে এদের যা হয়েছে তা কল্পনাও করা যায় না। এদের ব্যবসা বাড়াতে খোদ দেশের জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী বাসাবাড়ির গ্যাস বন্ধ করে সবাইকে এলিপিজি কেনার নসিহত দেন। কারণ এই গ্রুপের এলিপিজি ব্যবসা রয়েছে।
এই বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকের ছেলে বিএনপি আমলে খুনের অভিযোগে পালিয়ে যায়। আবার হাল আমলে নারী কেলেঙ্কারীতে জড়িত হয়েও পার পেয়ে যায়। এসব ঘটনা যখন ঘটছিল তখন অভিযুক্ত ভূমিদস্যুর ছেলে অর্জন করে সাংবাদিক সংগঠন ক্রাব পুরস্কার। যেই সংগঠনের জন্ম অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করা তারাই তাকে বিশেষ ব্যক্তিত্বের সনদ দেয়।
২০০৮ সালে কেয়ার টেকার সরকারের সময় এই গোষ্ঠীর পুরো পরিবার ছিল লন্ডনে পালিয়ে। যেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো, এরা ফুলে ফেপে বাড়তে লাগলো। যা আজ বটগাছ। এমনটা বাংলাদেশে নজিরবিহীন। এদের পিছনে ভারত সরকারের আর্শীবাদ আছে এমনটা কেউ কেউ বলে থাকে। ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের প্রেস মিনিস্টার এই গোষ্ঠীর সাংবাদিক।
আজ সাগর রুনি হত্যার বিচার সাংবাদিকরা পায় না। এইখানেও আছে সেই মিডিয়া মালিকদের প্রভাব।
আজ ডিমের দাম ১৫৫ টাকা ডজন। এইখানে কাজ করছে কাজী গ্রুপ। যাদের দীপ্ত টিভি ও বাংলা ট্রিবিউন রয়েছে। বাজারে ডিম ব্যবসায়ীদের অভিযোগ এই কাজী গ্রুপ বাজারে কারসাজি করে ডিমের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশে আজ জনগণের মধ্যে যে অশান্তি বিরাজ করছে তার গোড়ায় দেখবেন এই মিডিয়া মালিকদের এক বিশাল ভূমিকা। যে কারণে এদেশে গণতন্ত্র ডানা মেলে উড়তে পারছে না। এটি একটি বিশেষ জায়গায় বসে আছে। মুষ্টিমেয় কিছু লোকের ভাগ্য উন্নয়ন হচ্ছে। আগামীতে যারা ক্ষমতায় আসবেন তাদেরও এই গোষ্ঠীর সহায়তা নিয়ে চলতে হবে।
প্রতিটি মিডিয়ার চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গেলে লেখা দীর্ঘ হযে যাবে। দেখা যাবে লোম বাছতে কম্বল উজার হবার পরিস্থিতি। আজ অনেকে সাংবাদিকদের ঘৃণা করেন। সাংবাদিকদের নিয়ে বিষোদগার করে। এর মূল কারণ হচ্ছে এই সাংবাদিকরা লুটপাটকারীদের সহযোগী হওয়া। সাংবাদিকরা নিজেদের মেধা দিয়ে লুটপাটকারীদের, দুর্নীতিবাজদের, অপরাধীদের, আড়ালে রাখে। মালিক পক্ষের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন প্রতিবেদন তারা প্রকাশ করবে না। এজন্য এদেশে আজ গণতন্ত্র কায়েম হয়নি। প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে চোরতন্ত্র।
লেখক: সাংবাদিক , তারিখ ৫ আগস্ট শনিবার ২০২৩।
ঢাকানিউজ২৪.কম / এসডি
আপনার মতামত লিখুন: