• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৬ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

বিশ্ব-মানব হবি যদি শাশ্বত বাঙ্গালি হ


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ০৯:২১ এএম
mongol
মঙ্গল শোভা যাত্রা, ফাইল ছবি

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

বাংলায় ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবর্তক গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২—১৯৪১) তাঁর 'বাঙলি হ' নামক বিখ্যাত কবিতায় বাঙালিকে অনুকরণের খোলস ভেদ করে আগে মানুষ হতে বলেছেন। পরবর্তীতে শাশ্বত বাঙালি হতে বলেছেন। যদি ষোল আনা প্রকৃত বাঙালি হতে না পারলে, তবে কোনদিনও বাঙালি বিশ্বমানব হতে পারবে না। শুধুই খোলসের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে থাকবে।

"মানুষ হ' মানুষ হ'

আবার তোরা মানুষ হ'-

বাহ্যরূপে খোলস ভেদি'

সম্পূর্ণ বাঙ্গালি হ'।

শিখে নে দেশ-বিদেশের জ্ঞান

তবু হারাস নে মা'র দান

বাংলা ভাষার বুলি চেলে

বাংলা ধাঁজে নেচে খেলে

বাংলা ভাবে পরাণ মেলে

বাংলা সেবায় জীবন ঢেলে

কায়-মনে বাঙ্গালি হ'-

ষোল আনা বাঙ্গালি হ'।

বিশ্ব-মানব হবি যদি

শাশ্বত বাঙ্গালি হ'।"

এমন আগে মানুষ হওয়ার কথা যেমন ঋগ্বেদ সংহিতার (১০.৫৩.০৬) মধ্যে আছে তেমনি ভাবে মহাভারতের বনপর্বের অন্তর্গত হংসগীতাতেও আছে। সেই ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি চণ্ডীদাস বলেছেন, "সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই"। আমরা সব হতে চাই, কিন্তু মানুষ হতে চাই না।মানুষের ঘরে জন্ম নিলেই কেউ মানুষ হয়ে যায়। মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। একটি কুকুরকে জন্ম থেকেই কুকুর বলে, একটি শূকরকে জন্ম থেকেই শূকর বলে, একটি বিড়ালকে জন্ম থেকেই বিড়াল বলে। শুধুই ব্যতিক্রম মানুষ। তাকে জন্ম থেকেই কেউ মানুষ বলে না, মনুষ্যত্ব অর্জন করলেই তবে তাকে মানুষ বলে। গুরুসদয় দত্ত মনুষ্যত্ব এবং বাঙালিত্বকে অনেকটা সমপর্যায় ভুক্ত করে প্রয়োগ করেছেন।তাই তিনি আগে মানুষ হতে বলেছেন, পরে যুগপৎভাবে দেহ-মনে ষোল আনা বাঙালি হতে বলেছেন।

বর্তমানে বাংলাদেশের কিছু পশ্চাদপদ দক্ষিণপন্থী মানুষ বাঙালি ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি থেকে দ্রতগতিতে দূরে চলে যাচ্ছে। অবশ্য গুটিকয়েক তথাকথিত শিক্ষিত এবং বুদ্ধিজীবী সজ্ঞানেই যাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ সাধারণ মানুষই অন্যের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে অজ্ঞানে আবব্ধ হয়ে বাঙালি ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।দেশ ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপরে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সেই জাতীয়তাবাদ তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিলো। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু সেই উদ্যোগ যথাযথভাবে নেয়া হয়নি। যতটুকু নেয়া হয়েছে সকলই নমঃ নমঃ করে দায়সারা গোছের অনেকটা । তাই আজকে দেশে রাজাকারি মানসিকতার দেশদ্রোহীদের প্রকাশ্য আস্ফালন প্রতিনিয়ত আমরা দেখছি। এদের কোষ্ঠী ঠিকুজী খুঁজলে দেখা যাবে, এদের বাবা এবং দাদারাই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ছিলো।এরা সর্বদাই থাকে সুযোগের অপেক্ষায়। তাদের দৃষ্টিতে এবং তাদের পরিভাষায় বাঙালি সংস্কৃতি মানেই হিন্দু সংস্কৃতি। তাই তা পরিত্যাজ্য।বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং লজ্জার। এই বাঙালি নামক কুলাঙ্গাররাই ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল, ১৪০৮ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখের দিন ভোরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানস্থলে বোমা বিস্ফোরণ করে। তারা রমনা বটমুলে দুটি বোমা পুঁতে রেখে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটায়। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে একটি ও ১০-১৫ মিনিটে আরেকটি বোমার বিস্ফোরণ করে। নৃশংস এ বোমা হামলায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ৯ জন। পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন আরও একজন। মৃত দশজনের মধ্যে নয়জনই সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দর্শক। পাশাপাশি আহত হন আরো অগণিত মানুষ। মৃত প্রায় সকলেরই বয়স পয়ত্রিশ বছরের নিচে। এ মৌলবাদী শক্তি চেয়েছিলো ভয় এবং ত্রাশ সৃষ্টি করে সাধারণ বাঙালিকে নববর্ষ থেকে দূরে রাখা। কিন্তু তাদের সেই লক্ষ্য অপূর্ণই থেকে গেছে। পরের বছর ২০০২ সালে দেখা যায় আরও বেশি মানুষের সমাগম হয়েছিলো রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে। এরা হয়তো জানে না, বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্রের অন্ত নেই। ২০০১ সালে যেমন মৌলবাদী গোষ্ঠী রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়েছিলো, সেই তাদেরই চিন্তা চেতনার অনুসারীরা ২০২৩ সালে এসে বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বন্ধে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিনকে।৯. ০৪. ২০২৩ রবিবার রেজিস্ট্রি ডাকে নোটিশটি পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান। এতে বলা হয়েছে:

"পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাজার বছর ধরে, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাঙালি জনগণ একে অপরের ধর্মকে সম্মান করে এই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে আসছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে একটি কৃত্রিম কার্যকলাপ বাঙালি সংস্কৃতি পহেলা বৈশাখের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত এই কৃত্রিম উদ্ভাবিত মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের কোনও সম্পর্ক নেই।

নোটিশে বলা হয়, ‘মঙ্গল’ শব্দটি একটি ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ। সব ধর্মের লোকজন তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে ‘মঙ্গল’ প্রার্থনা করে থাকেন। এখন এই মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২-ক এর সরাসরি লঙ্ঘন। এটা দণ্ডবিধির (Penal Code) ২৯৫-ক ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধও।

তাই নোটিশ পাওয়ার পর ‘অসাংবিধানিক, বেআইনি ও কৃত্রিম উদ্ভাবিত’ মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যথায় এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়।"

('মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আইনি নোটিশ', বাংলা ট্রিবিউন, ০৯.০৪.২০২৩)

নোটিশ প্রদানকারীর যুক্তিতে, মঙ্গল শোভাযাত্রার 'মঙ্গল' শব্দটি যেহেতু একটি ধর্মীয় সংশ্লিষ্ট শব্দ, অর্থাৎ সনাতন ধর্মীয় শব্দ তাই এ শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না। হাস্যকর তার যুক্তি। ভাবা যায়, সুপ্রিম কোর্টের মত স্থানেও কী পরিমাণে মৌলবাদী গোষ্ঠী দানা বেঁধে আছে! নোটিশ প্রদানকারী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান নোটিশটিতে আরও লিখেন যে-

মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের দৈত্য আকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২-ক এর সরাসরি লঙ্ঘন এবং দণ্ডবিধির (Penal Code) ২৯৫-ক ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ বটে। তার এ যুক্তিতে ইসলাম ধর্মে যা নিষিদ্ধ তার কিছুই দেশে করা যাবে না। তার এ যুক্তিতে হিন্দু, বৌদ্ধ সম্প্রদায় মন্দিরে প্রতিমা পূজাও করতে পারবে না। কারণ তা ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। অথচ বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে সকল নাগরিকদেরই সমান অধিকার। নোটিশ প্রদানকারীদের নিষিদ্ধকরণের বিবিধ দাবির সাহস যদি এভাবে বাড়তে থাকে, তবে তারা হয়ত একদিন সময় সুযোগে বলে ফেলবে যে দেশের যাদুঘরেও কোন মূর্তি বা ভাষ্কর্য থাকতে পারবে না। যাদুঘরে মূর্তিও তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, এবং দণ্ডবিধির (Penal Code) ২৯৫-ক ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ একই দাবি করে নিজ দেশের যাদুঘরের প্রায় সকল প্রত্নসম্পদ প্রকাশ্যে ধ্বংস করেছে আফগানিস্তানের তালিবান এবং সিরিয়ার আইএস জঙ্গি গোষ্ঠী। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আমরা মৌলবাদীদের বাড়বাড়ন্তের চূড়ান্ত ভবিষ্যতের সে দিনগুলো দেখতে চাই না। কারণ এ দেশটা স্বাধীন হওয়ার পিছনে এ মৌলবাদী গোষ্ঠীর নূন্যতম কোন ভূমিকা নেই। বরং তারা অধিকাংশই ছিলো দেশদ্রোহী রাজাকারের ভূমিকায়। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো দেশটি যেন স্বাধীন না হয় এবং তাদের পেয়ারে পাকিস্তান যেন খণ্ডিত না হয়। এর পরেও মৌলবাদী দেশদ্রোহী রাজাকারের মুখে ছাই দিয়ে একসমুদ্র রক্তে স্নাত হয়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা পেয়েছি একটি নতুন মানচিত্র, নতুন পরিচয়। এবং সাতসমুদ্র সেঁচা ধন, যার নাম 'স্বাধীনতা'। তাই সে স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার প্রেরণা বাঙালি ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির বিবিধ অনুষঙ্গকে সুরক্ষিত করাই রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে সাথে আমাদেরও কর্তব্য।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকানিউজ২৪.কম / এসডি

আরো পড়ুন

banner image
banner image