নিউজ ডেস্ক: ৫০০ দিন অতিক্রম করেছে ইউক্রেন যুদ্ধ। তিন থেকে সাত দিনের সফলতার আকাঙ্ক্ষা এতদিনেও পূরণ হয়নি। নিজেদের ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে পারেনি কিয়েভ বাহিনীও। কারো কাছেই তাদের কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসেনি। তবে অপ্রত্যাশিত সব হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে এই যুদ্ধে। অকালেই অনেককে চলে যেতে হয়েছে। বিশ্বের সব মানুষকেই যুদ্ধের ভয়ংকর প্রভাব মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়াতে বারুদের মতো সহায়তা করেছে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। কিন্তু এসব আলোচনার মধ্যেই গত কয়েক দিন ধরে ক্লাস্টার বা গুচ্ছ বোমা আলোচনায় এসেছে।
গুচ্ছ বোমা এতটা ভয়ংকর যে, ১২০টির বেশি দেশে এই বোমার ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে এই বোমা সরবরাহ করছে। মার্কিন মিত্র এবং জাতিসংঘও এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে। যদিও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে তার কয়েক দিন সময় লেগেছে। কিন্তু অস্ত্র ফুরিয়ে যাওয়ায় ইউক্রেনকে অরক্ষিত রাখাও ওয়াশিংটনের পক্ষে সম্ভব নয় বলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।
ক্লাস্টার বোমা কী: ক্লাস্টার বোমা এক ধরনের প্রাণঘাতী যুদ্ধাস্ত্র। এর মধ্যে একাধিক বিস্ফোরক বা বোমা থাকে। গুচ্ছ বোমার একটি ক্যানিস্টার (দেখতে রকেটের মতো) ১০টি থেকে শুরু করে শত শত ছোট বোমা বহন করতে পারে। ক্যানিস্টারগুলো বিমান, আর্টিলারি, নৌ বন্দুক অথবা রকেট লঞ্চার থেকে নিক্ষেপ করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম ব্যবহার হয় ক্লাস্টার বোমা।
বিস্তৃত অঞ্চলে আঘাত হানতে সক্ষম: কীভাবে এই ক্লাস্টার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে তার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের এ ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একটি বিমান থেকে বোমাটি ছোড়া হয়েছে, যা নিচের দিকে আসতে থাকে। এর মধ্যেই বোমাটি বিস্ফোরিত হয়ে ছোট ছোট বোমাগুলো বেরিয়ে আসে। তখন এগুলো নিচে আছড়ে পড়ে অসংখ্যবার বিস্ফোরণ ঘটায়। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনীয়দের যে ধরনের বোমা দিচ্ছে, সেটি হাউইটজার কামান থেকে ছোঁড়া যাবে। ১৫৫ মিলিমিটার এ ক্লাস্টার বোমার ভেতর ছোট ছোট ৮০টি বোমা রয়েছে। ইউক্রেনীয় সেনাদের ঠেকাতে রুশ সেনারা যেসব জায়গায় পরিখা খনন করেছে, সেসব জায়গায় এ বোমা ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছেন দেশটির সামরিক কর্মকর্তারা। এর সাহায্যে ধ্বংস করা যায় ট্যাংকের মতো সাঁজোয়া যুদ্ধযান, বৈদ্যুতিক পাওয়ার ট্রান্সমিশন ও যুদ্ধ বিমানের রানওয়ে।
কেন নিষিদ্ধ এই অস্ত্র?: n ২০০৮ সালে এ বোমা নিষিদ্ধ করে ১২০টির বেশি দেশ, যার মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো মার্কিন মিত্র দেশ। কিন্তু এ চুক্তির বাইরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইউক্রেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রে গুচ্ছ বোমা উৎপাদন, ব্যবহার ও পরিবহন নিষিদ্ধ। সেই আইনকে পাশ কাটিয়ে ইউক্রেনকে এ বোমা দিচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। চুক্তি অনুযায়ী, বেসামরিক জনগণের ওপর নির্বিচারে মারাত্মক প্রভাব রাখার কারণে ক্লাস্টার অস্ত্রের ব্যবহার ও মজুতকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। বিশেষ করে, শিশুদের এই অস্ত্রের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কারণ এই বোমাগুলো আবাসিক বা কৃষি এলাকার আশপাশে পড়ে থাকতে দেখা যায়, অনেক সময় বোমাগুলোকে ছোট খেলনার মতো দেখায়; ফলে কৌতূহলবশত শিশুরা এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। বিশ্ব জুড়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো ক্লাস্টার অস্ত্রের ব্যবহারকে ঘৃণ্য এবং এমনকি যুদ্ধাপরাধ হিসেবেও বর্ণনা করেছে।
কারা এখনো এই অস্ত্র ব্যবহার করছে? : ইরাকে ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তার কারণে ২০১৬ সালে এ বোমার ব্যবহার বন্ধ করে দেশটি। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয়ই ক্লাস্টার যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করে আসছে। পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু পর থেকে রাশিয়ার ক্লাস্টার বোমা ব্যবহারের সমালোচনা করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রই ইউক্রেনকে এই অস্ত্র সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে।
সম্প্রতি তুরস্কের দেওয়া ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার শুরু করে ইউক্রেন। ক্লাস্টার অস্ত্র সরবরাহের জন্য গত বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে আসছিলেন ইউক্রেনের কর্মকর্তারা। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়ার ক্লাস্টার বোমার ‘ডাড রেট’ ৪০ শতাংশ; অর্থাৎ নিক্ষেপিত বোমার একটি বড় অংশই মাটিতে বিপজ্জনক অবস্থায় থেকে যায়। যেখানে ক্লাস্টারের গড় ডাড রেট সাধারণত ২০ শতাংশের কাছাকাছি হয়ে থাকে বলে মনে করা হয়। পেন্টাগনের তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাস্টার বোমার ডাড রেট ৩ শতাংশেরও কম।
কেন ইউক্রেন ক্লাস্টার বোমা চায়?: ইউক্রেন বাহিনী মরিয়াভাবে ক্লাস্টার বোমা পেতে চাচ্ছে যাতে রাশিয়ানদের মতো তারা এই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। বিশেষ করে সেই সব পরিস্থিতিতে যখন দেশটির পশ্চিমা মিত্ররা পরিস্থিতি সামলে উঠতে ব্যর্থ হতে পারে। আবার পর্যাপ্ত কামানের গোলাবারুদ না থাকায়, ইউক্রেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ক্লাস্টার যুদ্ধাস্ত্রের সরবরাহ করতে অনুরোধ করেছে যাতে রাশিয়ান পদাতিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে সমস্ত প্রতিরক্ষামূলক পরিখা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
মার্কিন সিদ্ধান্ত কী প্রভাব ফেলবে?: অবিলম্বে এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নীতিগতভাবে যেই অবস্থানে আছে তা থেকে অনেকটাই সরে দাঁড়াবে। এই পদক্ষেপের ফলে দেশটির বিরুদ্ধে সমালোচনা বাড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। যেহেতু ক্লাস্টার যুদ্ধাস্ত্র বিশ্বের অনেক দেশে নিষিদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের ফলে অনিবার্যভাবে দেশটি পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে বেশ কিছুটা মতবিরোধের মধ্যে থাকবে। বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের পরিমাণ বাড়তে পারে। এমনকি ইউক্রেন শেষ পর্যন্ত হয়তো-বা রাশিয়ার ভূখণ্ডেও ভয়ংকর এই গুচ্ছ বোমা ব্যবহার করতে পারে। সেটি হলে যুদ্ধ আরো ভয়ংকর ও মারাত্মক রূপ পাবে।
ঢাকানিউজ২৪.কম /
আপনার মতামত লিখুন: