• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৬ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

বিএনপির পাকিস্তান প্রীতির উদ্দেশ্য কী?


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০৬:৪৯ পিএম
উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো
bnp logo

আবদুল মান্নান

বিএনপির রাজনীতিতে পাকিস্তানের ভাবধারার একটি প্রছন্ন ছায়া আছে তা কোনও রাখঢাকের ব্যাপার নয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে পাকিস্তানের কুখ্যাত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বাংলাদেশে তাদের যত রকমের কুকর্মের এজেন্ডা আছে তা সহজে বাস্তবায়ন করতে পারে। হোক না তা উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে অর্থ আর অস্ত্রের জোগান দেওয়া অথবা বাংলাদেশের জঙ্গিবাদী দলগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করা।

পাঠক নিশ্চয়ই ভুলে যাননি ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার অন্যতম হোতা মওলানা তাজউদ্দিনকে বেগম খালেদা জিয়া আর তারেক রহমান পাকিস্তান পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখনও বঙ্গবন্ধুর খুনিরা যারা পলাতক আছেন তাদের বেশিরভাগই পাকিস্তানি পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। দুই একজন পাকিস্তানেই থেকে ব্যবসা করেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এক এগারোর পর বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের শীর্ষস্থানীয় পরিকল্পনাকারী কর্নেল (বরখাস্ত) আবদুর রশিদকে একটি অনুষ্ঠানে এনে তার সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল। এই সেই আবদুর রশিদ যাকে বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে কুমিল্লার একটি আসন থেকে জিতিয়ে এনে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসিয়ে সংসদকে অপবিত্র করেছিলেন। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ঘাতকদের বেআইনি সরকারকে প্রথম যে রাষ্ট্রটি স্বীকৃতি দেয় সেটি হচ্ছে পাকিস্তান। তার আগে পাকিস্তানি কায়দায় বাংলাদেশ বেতার হয়ে যায় রেডিও বাংলাদেশ আর জাতীয় স্লোগান হয়ে যায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। বিএনপি সরকারে থাকার সময় একাধিকবার তাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য জাতীয় সংগীত পাল্টে ফেলার জন্য প্রস্তাব করেন। কারণ, ওটা নাকি হিন্দুর লেখা। রবীন্দ্রনাথ মোটেও হিন্দু ছিলেন না। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের সদস্য, এক ঈশ্বরবাদী।

দু’একবার বিএনপির মিত্র জামায়াত দেশের পতাকা বদলের চিন্তা করেছিল। পাকিস্তানের একসময়কার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল আসাদ দুররানি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মাহমুদ চৌধুরীর আদালতে এক মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে ২০১৫ সালে স্বীকার করেছিলেন, আইএসআই’র মাধ্যমে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান বিএনপিকে পঞ্চাশ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিল। ২০০১ নির্বাচনের আগে একই কাজ করতে গিয়ে ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের একাধিক কর্মকর্তা হাতেনাতে ধরা পড়ে। পরে তাদের বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

গত ১৫ সেপ্টেম্বর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার নিজ জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের কালীবাড়ির বাসভবনে সাংবাদিকদের সামনে বর্তমান সময়ে দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন– ‘এর চেয়ে তো পাকিস্তান আমলেই ভালো ছিলাম’। বিএনপি নামক দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মহাসচিবের মুখ হতে এমন কথা আসা চরম ধৃষ্টতাই নয়, এটি একটি বড় ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে দেখা যেতে পারে। এমন বক্তব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের সাথে স্রেফ বেইমানি ছাড়া আর কিছুই নয়।

বিএনপিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন এটি সত্য কিন্তু দুর্ভাগ্য তারা কেউ মির্জা ফখরুলের এমন ঔদ্ধত্বপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদ করেননি। বরং উল্টো কেউ কেউ মির্জা ফখরুলের বক্তব্যকে সমর্থন করে বলেছেন, পাকিস্তান আমলে নিত্যপণ্য বা ডলারের দাম কত ছিল আর বর্তমানে বাংলাদেশে তা কত হয়েছে। বিএনপির এসব নেতানেত্রী মনে হয় কুয়ার মধ্যে থাকেন, দুনিয়ার কোনও খোঁজ খবর রাখেন না। বেগম খালেদা জিয়ার একজন অতন্দ্র প্রহরী প্রায়ই টিভিতে তার বর্তমান নেতা বেগম জিয়া আর পলাতক বিএনপি চেয়ারম্যান, একসময় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তার বর্তমান দলের নেতানেত্রীদের সমর্থনে নানা ধরনের কুতর্কে জড়িয়ে পড়েন।  মির্জা ফখরুল যেদিন অকপটে বলে ফেললেন তারা পাকিস্তান আমলেই ভালো ছিলেন সেই রাতে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এসে তিনি মির্জা সাহেবের পক্ষে ব্যাট চালানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, পাকিস্তান আমলে এক ডলার সমান চার টাকা ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে এক ডলার কিনতে হয় একশত টাকার বেশি দিয়ে। তিনি কি জানেন না বর্তমান সময়ে পাকিস্তানে এক ডলার কিনতে ১৯৫ পাকিস্তানি রুপির প্রয়োজন হয়। পাকিস্তানের বৈদশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ১৪ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে আর বাংলাদেশে তা ৩৮ বিলিয়ন ডলার। তাদের অর্থনীতির পরিস্থিতি এতই খারাপ যে দেশটির সংসদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের যেকোনও স্থাবর সম্পদ বিদেশিদের কাছে কোনও সংস্থা বা প্রদেশ চাইলে বিক্রি করে দিতে পারে। সম্প্রতি কাতার পাকিস্তানের রাজধানীর ইসলামাবাদ বিমানবন্দর ক্রয় করার অফার দিয়েছে। দরকষাকষি চলছে। এরইমধ্যে কাতার পিআইএ’র সিংহভাগ শেয়ার ৫ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ক্রয় করার অফার দিয়েছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে কিছু দিন পর করাচি বন্দরও নিলামে উঠতে পারে। একটি দেশের জন্য এর চেয়ে লজ্জাজনক কোনও সিদ্ধান্ত হতে পারে না। পাকিস্তানের চিন্তাশীল অর্থনীতিবিদরা প্রায়শ’ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদাহরণ টানতে গিয়ে বলেন, পাকিস্তানের উচিত এখন বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল অনুসরণ করা। ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তার মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে বলেন, তিনি পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য সুইডেন মডেল অনুসরণ করতে চান। সেই রাতে পাকিস্তানের সকল টিভি চ্যানেলে উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা একযোগে বলেন, পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য সুইডেন মডেলের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন বাংলাদেশ মডেল।  তারা পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের এই চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন দেখে তার জন্য তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন।

প্রথমটি হচ্ছে সামরিক বাহিনীকে দেশের রাজনীতিতে নাক গলানোর সুযোগ না দেওয়া। বিশ্বে কোনও সামরিক শাসকের অধীনে কোনও দেশ উন্নয়ন করেছে তার নজির বিরল। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন, যা পাকিস্তান পারেনি। বাংলাদেশের ধর্মান্ধ অর্ধশিক্ষিত মোল্লাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলাদেশের নারীরা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে কর্মরত ও অনেক স্থানে নেতৃত্ব দিচ্ছে। সব শেষে তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন, তিনি নানা বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন এবং দেশে একটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এনেছেন। এই মুহূর্তে বিএনপি আর তার মিত্ররা এই স্থিতিশীলতা ধ্বংস করার জন্য মাঠে নেমেছে, কারণ তারা বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায়। মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের সাফাই গাইতে গিয়ে বিএনপির আর এক নেতা নজরুল ইসলাম খান বুধবার (২১ সেপ্টম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মির্জা ফখরুল তার বক্তব্যে আসলে বর্তমান সময়ে সরকারের দমন পীড়নের কথা বুঝাতে চেয়েছেন। খান সাহেব তো দীর্ঘদিন শ্রমিক রাজনীতি করেছেন। তিনি ভুলে গেছেন পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসক আইউব খানের দশ বছরের দুঃশাসনের কথা। এই দশ বছরে ক’জন রাজনৈতিক নেতা জেলের বাইরে ছিলেন? বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর তিনি দল বদল করে বাংলাদেশের প্রথম সেনা শাসক জেনারেল জিয়ার মুরিদ হয়ে গেলেন। জিয়া তো তার অবৈধ শাসনই শুরু করেছিলেন বাংলাদেশকে একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তর করার মধ্য দিয়ে। তিনি বাহাত্তরের সংবিধান হতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাকে’ বাদ দিয়ে একাত্তরে যেসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তাদের আবার রাজনীতি করার সুযোগ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।

যুদ্ধাপরাধীর দল জামায়াতের আমির গোলাম আযমকে পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসার পথ পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। আর তার স্ত্রীর আমলে এই যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছিল। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিফ নেওয়াজ জানজুয়া ১৯৯৩ সালের ৮ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সকল রাষ্ট্রাচার ভঙ্গ করে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের কাছে এক শোক বার্তা পাঠান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখনও কোনও শোক জানাননি, কারণ পরাজিত জেনারেলের জন্য শোক প্রকাশের কোনও রেওয়াজ নেই। একাত্তরে জানজুয়া বাংলাদেশে ছিলেন এবং মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। মির্জা ফখরুলের মতে বাংলাদেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা বেগম খালেদা জিয়া তখন জানজুয়ার অতিথি হিসেবে সেনানিবাসে নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলেন। ২০০৫ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার, যিনি যুদ্ধকালে (৩ ডিসেম্বর ১৯৭১-১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) যৌথ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন, সেই লে. জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরার মৃত্যু হলো। তখনও বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী। তিনি কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে কোনও শোকবার্তা পাঠাননি।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব যিনি বর্তমানে রাজনীতির একটি রিলিফ ক্যারেক্টার জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে গত ১৭ তারিখ প্রশ্ন করেছেন ‘পাকিস্তান আমলের কথা শুনলে আওয়ামী লীগের এত লাগে কেন?’ রিজভী সাহেব নিশ্চয় জানেন, লাগে কারণ আমাদের কাঁধ হতে পাকিস্তানের জোয়াল মুক্ত করতে ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন আর প্রায় তিন লাখ মা বোন তাঁদের সম্ভ্রম খুইয়েছেন। রিজভী তো একসময় বামপন্থী রাজনীতি করতেন। তার তো এসব না জানার কথা নয়। বুধবার আওয়ামী লীগের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দলীয় এক সভায় বলেছেন বিএনপি বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানাতে চায়। আসলে তারা তা করেছিল। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তা থেমে যায়। তারা এখন সুযোগ খুঁজছে তাদের থেমে যাওয়া যাত্রা আবার শুরু করতে।

বর্তমান সরকারের ভুল-ভ্রান্তি নেই তা কেউ বলবে না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তা সরকারকেই নিজ স্বার্থে বন্ধ করতে হবে। তাই বলে আবার পাকিস্তানে ফেরত যাওয়ার নীলনকশা বাস্তবায়ন? সময় থাকতে সকলকে সাবধান হতে হবে। আর যাদের পাকিস্তান ভালো লাগে তাদের সেখানে চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারও সাহায্য করতে পারে।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

 

ঢাকানিউজ২৪.কম /

আরো পড়ুন

banner image
banner image