
রুস্তম আলী খোকন
চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামে বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত হয়েছিল অনেক আগেই। মাস্টারদা সুর্যসেন জন্মেছিলেন ঐ গ্রামে। সেখানেই পঙ্কজ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৩৯ সালের ০৬ আগস্ট তারিখে। পিতা প্রফুল্ল কুমার ভট্টাচার্য উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রফুল্ল কুমার ভট্টাচার্য এসএসসিতে প্রথম শ্রেনীতে প্রথম সেইসাথে স্বর্ণপদক পেয়ে পাশ করে, প্রফুল্ল কুমার ভট্টাচার্য উচ্চ পদের চাকুরীর মোহ ত্যাগ করে ফিরে এসেছিলেন চট্টগ্রামে। আর সেখানেই যুক্ত হয়েছিল শিক্ষকতা পেশায়। মাতা মণিকুন্তলা ভট্টাচার্য মহীয়সী নারী। পিতা মাতা দুইজনেই ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থক।
১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী পঙ্কজ ভট্টাচার্য যখন চট্টগ্রাম কলিজিয়েট স্কুলের নিয়ম ভেঙে ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে বের করে ফেলেন ছাত্র মিছিল, তখন ঐ স্কুলেন আ্যাসিট্যান্ট হেডমাস্টার পিতা প্রফুল্ল কুমার ভট্টাচার্য। নিয়ম ভাঙার অপরাধে স্কুল কর্তৃপক্ষ সে যাত্রায় পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে সতর্ক করে দিলেও ১৯৫৭ সালে ত্রাণের দুধের কৌটা কালোবাজারিতে বিক্রির বিরুদ্ধে মিছিল বের করলে স্কুল কর্তৃপক্ষ আর ক্ষমা করেনি। সতর্কতার মধ্যে না থেকে পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে স্কুল থেকে বহিস্কার করে দিল স্কুল কর্তৃপক্ষ । পিতা প্রফুল্ল কুমার ভট্টাচার্য পুত্রের জন্য কিছুই বললেন না স্কুলের প্রধান শিক্ষককে। একবারের জন্য অনুরোধ করলেন না পুত্রের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের। আদর্শবাদী পিতা, পুত্রকে ভালো মন্দ, ন্যায় অন্যায় বুঝে ন্যায়ের পক্ষে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। অনুপ্রাণিত করেছিলেন ন্যায় প্রতিস্ঠায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার। আর তাতে অনুপ্রাণিত পুত্র ১৯৫৮ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়ে যুক্ত হয়ে যায় শিক্ষা কাজ ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে। পুর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন হয়ে যায় পঙ্কজ ভট্টাচার্যের ঠিকানা। সেই থেকে মৃত্যুর পুর্ব পর্যন্ত আদর্শের রাজনীতির ধারক হয়ে পঙ্কজ ভট্টাচার্য লড়াই করে গেছেন শোষিত মানুষের পক্ষে, শ্রেণীহীন সমাজের জন্যে।
সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে পঙ্কজ ভট্টাচার্য ষাট এর দশকে ছাত্র আন্দোলনের শুরুতেই নেতৃত্বে চলে আসেন। এসময়ে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ এর সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে । পঙ্কজ ভট্টাচার্য তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের একক নেতা। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ এসময়ে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ হতে ছাত্র আন্দোলনের দ্বায়িত্ব পালন করছিলেন। পঙ্কজ ভট্টাচার্য মানবমুক্তির আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্রের মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে যুক্ত হয়ে যায় কমিউনিস্ট পার্টিতে। কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সদস্য ছাত্র আন্দোলনে কাজ করতে থাকে। '৬২ এর শিক্ষা আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে পুর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হিসেবে রাজপথের অগ্রসেনানী।
এসময়ে সারা দুনিয়ার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে মস্কো-পিকিং বিভাজনের ধারা বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনেও বিভাজন সৃষ্টি করে। আর তাতে সমাজতন্ত্রে আস্হাশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন বিভাজিত হয়ে গেলে পঙ্কজ ভট্টাচার্য মস্কোপন্হী বলে যারা পরিচিত সেই অংশের ভেতর নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ছাত্র ইউনিয়নের সেই সময়ের সভাপতি বদরুল হক বাচ্চু কারাবরণ করলে পঙ্কজ ভট্টাচার্য সংগঠনের কার্যকরী সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন আর তার সভাপতিত্বে অনুস্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে ১৯৬৫ সালের ১-৩ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হল বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে অনুস্ঠিত সম্মেলনে মতিয়া চৌধুরীকে সভাপতি আর সাইফুদ্দিন আহমেদ মাণিককে সাধারণ সম্পাদক করে মস্কোপন্হী ছাত্র ইউনিয়নের নুতন কমিটি গঠিত হয়।
প্রতিহিংসাবশত পিকিংপন্থীদের হয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার বিরুদ্ধে একটি ঘড়ি চুরির মিথ্যা মামলা দিলে একমাসের অধিক সময় জেল খেটে আসেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য।
১৯৬৬ সালে পঙ্কজ ভট্টাচার্য ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপে যোগদান করেন। ১৯৬৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হয়ে যায় পঙ্কজ ভট্টাচার্য। জেলে জাতির পিতা শেখ মুজিবের সাথে একান্ত সান্নিধ্যে ছিলেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য। ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে জেল হতে মুক্তি পান। '৭০ '৭১ এর অগ্নিঝরা দিনগুলোতে এই তরুণ নেতা দাপিয়ে বেড়িয়েছে ঢাকার রাজপথ। তার ভরাট কন্ঠের শ্রুতিমধুর বক্তৃতা গণআন্দোলনে গণমানুষকে করতো আন্দোলিত।
১৯৭১ সালে ন্যাপ সিপিবি ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তার ভুমিকা অবিস্মরণীয়। আগরতলার তেজপুরে উনিশ হাজার গেরিলা বাহিনীকে সংঘটিত করতে রাতদিন পরিশ্রম করেছে । তিনি ছিলেন ন্যাপ বাহিনীর কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আওয়ামী লীগ নেতারা ন্যাপ,সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যদের মুক্তি বাহিনীতে অংশগ্রহনে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মুক্তিবাহিনীতে নিতে চাইতেন না। সেই সময়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারেরও ভীতি ছিল, কমিউনিস্টদের হাতে এই আন্দোলনটি চলে যায় কিনা। সেকারণে ভারত সরকারও কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যদের মুক্তি বাহিনীতে প্রবেশের ক্ষেত্রে অনাগ্রহী ছিল।কমরেড মণি সিংহ, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ যখন এবিষয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থন ও মুক্তিযুদ্ধে আলাদা গেরিলা বাহিনী গঠন নিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগিতায় ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যোগাযোগ স্হাপন করার চেস্টা করছেন সেই সময়ে পঙ্কজ ভট্টাচার্য দেশের ভেতর থেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য যাওয়া তরুণ তরুণীদের আগরতলার তেজপুরের ক্যাম্পে রিক্রুট করে দুই নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সাথে সম্পর্ক স্হাপন করে গেরিলা প্রশিক্ষণের কাজটি এগিয়ে নিয়ে যায়।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য মাত্র পয়ত্রিশ বছর বয়সে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক এর দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার রাজনৈতিক জীবনে সাংগঠনিক দক্ষতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা রাজনৈতিক পরিমন্ডলে সমাদৃত। পঙ্কজ ভট্টাচার্য এর মতন রাজনীতিবিদ এ বাংলাদেশে আর গড়ে উঠবে কিনা সন্দেহ। আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে, লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠে নিজেকে দেশের জন্য, জণগণের জন্য নিবেদিত প্রাণ রাজনীতিক আজকের রাজনীতিতে আর গড়ে উঠছে না।
পঙ্কজ ভট্টাচার্যের মত রাজনীতিকরা একসময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের মুল আদর্শ সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্রের লক্ষ্য নিয়েই পঙ্কজ ভট্টাচার্যরা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রাজনীতি করে গেছেন। সেই রাজনীতি শুকিয়ে মরা নদীর মতন স্রোত হারিয়ে সেখানে স্বার্থ আর লুটপাটের রাজনীতি, লুটপাটের অর্থনীতি। আদর্শহীনতার পথ ধরে, নীতিহীনতার স্রোতে বাংলাদেশ আজ ব্যবসায়ী লুটেরাগোস্ঠীর দেশে পরিণত হয়েছে। যেখানে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের ঘামে বাংলাদেশের চোখে ফোঁটা ফোঁটা জল। প্রতিমুহূর্তে শোষিত বাংলাদেশ, প্রতিমুহুর্তে প্রতারিত বাংলাদেশ।
পঙ্কজ ভট্টাচার্যরা একে একে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু আরেকজন পঙ্কজ ভট্টাচার্য বাংলাদেশ আর খুঁজে পাবে না। এই শুন্যতা কেমন করে পুরুণ হবে, তা আমরা কেউই জানি না।
বাংলাদেশে যদি আদর্শবাদী রাজনীতিক সৃষ্টি না হয়, বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে আদর্শ চর্চা না হয়, তাহলে ঘোর অন্ধকার অমানিশায় পতিত হবে বাংলাদেশ।
আগামীর বাংলাদেশে আদর্শের সুর্যের আকাঙ্খায় আমরা।সেই সুর্যের মাঝে ভেসে আসবে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের মতন রাজনীতিকদের মুখচ্ছবি।
পঙ্কজ ভট্টাচার্যের বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক: রুস্তম আলী খোকন, লেখক ও সংগঠক।
ঢাকানিউজ২৪.কম /
আপনার মতামত লিখুন: