• ঢাকা
  • বুধবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ০১ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • সরকারি নিবন্ধন নং ৬৮

Advertise your products here

banner image
website logo

ম্যাজিক কেবল পদ্মায় নয়


ঢাকানিউজ২৪.কম ; প্রকাশিত: সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১২:২২ পিএম
ম্যাজিক
পদ্মা সেতু

অজয় দাশগুপ্ত

ঢাকার গুলশানের বাসা থেকে সদরঘাট লঞ্চ স্টেশনে গাড়িতে পৌঁছাতে যত সময় লাগত, সেই সময়েই একই গাড়ি ব্যবহার করে গুলশানের বাসা থেকে পৌঁছে গেছি বরিশালের আগৈলঝাড়ার গ্রাম গৈলার বাড়িতে। প্রাইভেট কার কিংবা বাস, যে যানই ব্যবহার করি না কেন, মোটামুটি তিন ঘণ্টাতেই ঢাকা-বরিশাল রুটে যাতায়াত করা যায়। ঢাকা-খুলনা বা ঢাকা-যশোরেও সড়ক পথে মাত্র তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগে।

এ যে অপার বিস্ময়! আগামী বছর ঢাকা-খুলনা-যশোর রেলপথ পুরোপুরি চালু হলে বিস্ময়ের বোধকরি শেষ থাকবে না। দেড়শ’ কিলোমিটার পথ যেতে দিনভর বাসযাত্রা, কী যে দুর্ভোগ। ভুক্তভোগী ছাড়া কাউকে বোঝানো যাবে না। অতীতে অনেকের কাছে জানতে চেয়েছি, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, না-কি বরিশাল কোথায় বেড়াতে কিংবা অফিসিয়াল ট্যুরে যাবেন? উত্তর পেতে দেরি হতো না বরিশাল, সে তো অনেক দূর। তাদের বোঝাতে পারিনি, সড়ক পথে ঢাকা থেকে বরিশালের দূরত্ব ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্বের অনক তুলনায় ঢের কম। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের চেয়ে কুয়াকাটা ঢাকার অনেক কাছের বীচ। পদ্মা সেতু চালুর পর এখন রাত দুপুরেও যদি মনে করি গৈলা যাব, কোনো চিন্তা করতে হয় না।  

ঢাকায় বসবাসের শুরু ৫৫ বছর আগে, ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে। ছাত্রবৃত্তি ও টিউশানির ওপর ভরসা করে পড়তে এসেছি। ক্লাস শুরু হতে না হতেই ১১ দফা দাবি আদায়ে উনসত্তরের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে জড়িয়ে পড়ি। ১১ দফার এক নম্বর দফা ছিল শিক্ষা সংক্রান্ত। গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, বৈদেশিক নীতি, শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থ, রাজবন্দীদের মুক্তি অনেক দাবি। কিন্তু ছাত্র-জনতার মুখে মুখে প্রধান দাবি হয়ে ওঠে শেখ মুজিবের মুক্তি চাই। তিনি মুক্ত হয়ে নন্দিত হন বঙ্গবন্ধু হিসেবে। 

এর দু’বছর পরেই বঙ্গবন্ধুর আহবানে ঝাঁপিয়ে পড়ি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। মুক্ত স্বদেশ আর বাস্কেট কেস বা তলাবিহীন ঝুড়ি থাকবে না, সোনার বাংলা হবে নতুন স্লোগান তাঁর। আমাদের ক্লাস শুরু হয় ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। বরিশালের গৌরনদীতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দিয়ে ঢাকায় আসি লঞ্চে। বিকেল চারটায় গৌরনদী ঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ে, ঢাকায় পৌঁছি পরদিন সকাল আটটার দিকে। ১৬ ঘণ্টার জার্নি। সদরঘাট নেমে ঘণ্টা খানেক পথ রিকশায় জগন্নাথ হলে। বছর তিনেক আগে ঢাকায় যখন পড়তে আসি, বরিশাল থেকে যতবার যাতায়াত করেছি একই সময় লেগেছিল।

পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকার সদরঘাট থেকে বরিশালের লঞ্চে চাপার জন্য বাড়তি তিন ঘণ্টা হাতে রাখতে হয়েছে। নচেৎ লঞ্চ ফেল! আবার সকালে বরিশাল শহর এবং এ বিভাগের লঞ্চগুলো সদরঘাট থামার পর যানজট এড়িয়ে মূল সড়কে আসতেই কম পক্ষে ঘণ্টা খানেক লেগে যেত। গাবতলি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে আরিচা যেতেই প্রায় তিন ঘণ্টা। বরিশাল, যশোর, খুলনা যে রুটের বাসেই উঠতে চেয়েছি, অপেক্ষা ফেরির। ঢাকা-মাওয়া-জাজিরা রুটে জিপিও থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত সড়ক পথ ১০০ কিলোমিটার কম, কিন্তু প্রমত্ত পদ্মা নদী ফেরিতে পাড়ি দিতে প্রচুর সময়। 

২৬ জুন, ২০২২ইং সকাল থেকে দৃশপট আমূল পাল্টে গেল। আগের দিন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছিলেন পদ্মায় সড়ক ও রেল সেতু। আরও কিছুদিন আগে সেতুর টোল হার ঘোষণার পর একদল দুর্মুখের কত কথা এত বেশি টোল দিয়ে কম গাড়িই চলাচল করবে পদ্মা সেতু দিয়ে। টোল দিতে গাড়ির লম্বা সারি পড়বে, এমন শঙ্কাও ব্যক্ত হয়। সেতু উদ্বোধনের পর এক দুস্কৃতকারী রেলিং থেকে কয়েক হাজার নাট-বল্টুর একটি খুলে বীরত্ব জাহির করে বলেছিল এই তো আমাদের ত্রিশ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু, ভেঙে পড়ল বলে। এক বিরোধী নেত্রী তো ঠিকই বলেছিলেন জোরতালি দিয়ে বানানো সেতু! কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘পদ্মা সেতু চেতনা’-এর জয় হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো এবং রাজধানী ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ইতিমধ্যেই এ সেতুর সুফল পেতে শুরু করেছে। মংলা বন্দর, বেনাপোল স্থল বন্দর ও ভোমরা বন্দরের কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেছে। রেলপথ পুরোদস্তুর চালু হলে যোগাযোগ সুবিধার পাশাপাশি অর্থনীতিতে দেখতে পাব বড় উল্লম্ফন। পটুয়াখালী-বরগুনা-ভোলাও আর ‘অবহেলিত ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছাসের এলাকা’ নেই। 

কয়েকদিন আগে জামালপুর গিয়েছি প্রাইভেট কারে। বিমানবন্দর থেকে উড়াল পথে টঙ্গী বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে যেখানে গাড়ি পৌঁছাল, সময় লাগে কয়েক মিনিট। ২ সেপ্টেম্বর খুলে গেল এক্সপ্রেসওয়ে বিমান বন্দর থেকে ফার্মগেট। দেড়-দু’ঘণ্টার পথ মাত্র ১১-১২ মিনিটে যাওয়া যায়। ফের একটি মহলের মাথাব্যথা রাজধানীতে এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পরও কেন যানজট থাকবে? কেন ফার্মগেট এলাকায় অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়? যথাযথ উত্তর পেলেও বেহুদা কথা থামে না। দুই ঘণ্টার পথ ১১-১২ মিনিটে এসে আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করা যায় না? তেল খরচ ও গাড়ির ‘অবচয়’ কেন হিসাবের বাইরে রাখবেন? কয়েক মাসের মধ্যে এ পথের বাকি অংশ চালু হবে। তখন দুর্মুখরা কী বলবে? তিনশ’ ফুট-পূর্বাচল এলাকায় নবনির্মিত প্রশস্ত পথ পুরোপুরি চালুর আগেই মনে হচ্ছে স্বপ্নের পথ। ঢাকাকে বাইপাস করে যখন নতুন কয়েকটি প্রশস্ত পথ চালু হবে, তখন বিমান বন্দর থেকে ফার্মগেট হয়ে যাত্রাবাড়ি এক্সপ্রেসওয়ে প্রকৃত সুফল দেবে, সন্দেহ নেই। দিয়াবাড়ি-আগারগাঁও মেট্রোরেল উদ্বোধনের পর শুনেছি ‘ধনীদের রেলপথ’।

মেট্রোরেল নির্মাণের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়ে যেন এ রেলপথ না যায়, সেজন্য একটি মহলের মানববন্ধন দেখেছি। এখন নিশ্চিত করে বলতে পারি, আট মাসে এ রেলপথ যে আস্থা অর্জন করেছে, তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে এ রুট না গেলে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে মেট্রোলাইন চাই’ দাবিতে প্রবল আন্দোলন শুরু হতো। মেট্রোরেলের শব্দে ঘুমানো যায় না বা কাজ করা যায় না উত্তরা-মিরপুর এলাকার কেউ কিন্তু এমন অভিযোগ এ পর্যন্ত করেনি। উত্তরা-মিরপুর-ফার্মগেট-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-মতিঝিল মেট্রোরেল চালু হলে যাতায়াত পরিস্থিতির অনেক উন্নতি ঘটবে, তাতে সন্দেহ নেই। মেট্রোরেলের নতুন কয়েকটি রুটও কিন্তু এখন স্বপ্নের পর্যায়ে নেই। মাত্র কিছুদিন আগেও স্লোগান শুনেছি শেখ হাসিনার অবদান, পদ্মা সেতু দৃশ্যমান। এখন তাঁর অবদানে বাংলাদেশের আরও অনেক কিছুই দৃশ্যমান, যা মুগ্ধ করছে বিশ্বকেও।

আমরা স্কুলে পড়েছি টেমস নদীর তলদেশ দিয়ে সুরঙ্গপথ চলে গিয়েছে, যা বিশ্বের বিস্ময়। আমি কয়েক বছর আগে এ পথ হেঁটে অতিক্রম করেছি, মুগ্ধ তো বটেই। এখন বাংলাদেশের কর্ণফুলী নদীর তলদেশেই এমন পথ! পাশাপাশি চট্টগ্রামেও চালু হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ে। বন্দরের ক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। মাতারবাড়িতে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কক্সবাজারে সমুদ্রকে রানওয়ের জন্য ব্যবহার করে আধুনিক বিমান বন্দর নির্মাণ, এলএনজি টার্মিনাল চালু, কক্সবাজারকে নতুন রেলপথের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত করা মাত্র কয়েক বছর আগেও কি এমনটি কেউ ভেবেছে? ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হচ্ছে কিছুদিনের মধ্যেই। যোগাযোগ অবকাঠামোর সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে বিপুলভাবে। লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকা কিংবা ঘরে ঘরে অন্ধকার এখন অতীতের বিষয় হতে চলেছে। বাংলাদেশে পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দাবি সেই ষাটের দশক থেকে। শেখ হাসিনা তা বাস্তবয়ন করলেন। খাদ্যশস্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। সবজি, ফল, মাছ, মাংসের উৎপাদন বাড়ছে। এক যুগের বেশি সময় ধরে কোটি কোটি স্কুল শিক্ষার্থী পাচ্ছে বিনামূল্যে পাঠ্যবই। প্রায় এক কোটি ছাত্রছাত্রী শিক্ষাবৃত্তি পায়। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে এবং সেটা বড় চ্যালেঞ্জ বটে। এতে জয়ী হতেই হবে।  

২০০৮ সালে শেখ হাসিনা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান তুলেছিলেন, কতই না ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ শুনেছি। দেড় দশক পর সুদূর গ্রাম কিংবা চরাঞ্চল বা সমুদ্রে থেকেও এ সুবিধা ভোগ করা যায়।  স্মার্ট বাংলাদেশের গানও এখন দূরের কিছু মনে হয় না। শেখ হাসিনা ছিটমহল সমস্যার সমাধান করে বাংলাদেশের আয়তন বাড়িয়েছেন, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে সমুদ্র জয় করে বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় সমান সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব কায়েম করেছেন।

সমুদ্র অর্থনীতি বা বøু-ইকোনমি সঙ্গত কারণেই অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে পরিকল্পনায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ২০টি অর্থনীতির একটি হবে। এই তালিকায় রয়েছে পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়ার মতো সম্পদশালী দেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অনেক আগেই এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন এবং তা অর্র্জনে ভিতটাও শক্তভাবেই নির্মাণ করে চলেছেন। দূরদৃষ্টি রয়েছে বৈকি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর।
সড়ক, নৌ বা আকাশ পথে ঘুরে ঘুরে কিংবা মহাকাশ থেকে দেখুন না এ নতুন বাংলাদেশকে! বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের অবমাননাকর সারি থেকে উন্নয়নশীল দেশের গর্বিত কাতারে দাঁড়াবে, এমন সম্ভাবনার কথা বললে দেশ-বিদেশের একটি মহল এই কিছুকাল আগেও কিন্তু অবিশ্বাসের ভঙ্গীতে তাকাতেন। এখন ভুল ভাঙবে তাদের, এ প্রত্যাশা রাখি। 
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক                                                          
 

ঢাকানিউজ২৪.কম / কেএন

আরো পড়ুন

banner image
banner image